ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন ও টিউশন ফি

অলোক আচার্য
🕐 ৭:২২ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৮, ২০২০

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি দীর্ঘসময় ধরে থমকে আছে। টেলিভিশন, অনলাইনে এ কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের সবাইকে এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না। নানাবিধ সমস্যার কারণেই সেটি সম্ভব হয়নি। করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। সেপ্টেম্বরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা গেলে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার কথা শোনা যাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষাবর্ষ বৃদ্ধি করে এবং আগামী শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার কথা গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। তবে কোনো উপায়ে মূল্যায়ন হবে এটা নিশ্চিত। কারণ অটোপ্রমোশন দেওয়া হবে না।

কোনো শ্রেণির যোগ্যতা মূল্যায়ন না করে পরবর্তী শ্রেণিতে পদার্পণ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ একটি শ্রেণিতে যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে তা শ্রেণি অনুসারে সাজানো থাকে। সপ্তম শ্রেণির সিলেবাস সম্পর্কে ধারণা না থাকলে অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে সেই ছাত্র-ছাত্রীকে সমস্যায় পরতে হবে। করোনার কারণে কার্যত পুরো বিশ^ই এখন থমকে আছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে উচ্চশিক্ষায় দীর্ঘ সেশন জট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কতদিনে এই শিক্ষা কার্যক্রম আগের অবস্থায় ফিরবে তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে সেপ্টেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এসবই পরিকল্পনা এবং যা শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গল কর্তৃপক্ষ সেই সিদ্ধান্তই নেবেন। সামনে আরও দুটো পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা।

ক্লাস নেওয়া যেহেতু সম্ভব হয়নি, ফলে তাদের পরীক্ষা সুনির্দিষ্ট সময়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এখন চ্যালেঞ্জ হলো করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে নিজেকে এবং বিশ^কে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা এখন নিজেদের ঘরবন্দি করে রাখছি। করোনাভাইরাস যখন থেকে তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখাতে শুরু করে তখন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের দেশের শিশুদের মাঝে যাতে এই ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে না। 

করোনাকালে কম বেশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষই সমস্যায় আছেন। শিক্ষকরাও এর বাইরে নন। শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যা প্রতিনিয়ত মানবতা ও মনুষ্যত্বের উন্মেষ ঘটিয়ে চলেছে। সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই কাজটি এক শ্রেণির মানুষ করে আসছে। শিক্ষাদানের প্রতিটি স্তরে যারা এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে তাদের সবার দায়িত্বই এক। কিন্তু সব শিক্ষকের জীবনযাপন কি একই সরলরেখায় প্রবাহিত হয়? বহু প্রতিকূলতায়ও শিক্ষকদের শিক্ষাদানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ হয়নি। কম পারিশ্রমিক, প্রতিকূল পরিবেশ কোনো কিছুই শিক্ষকদের দমাতে পারেনি। শিক্ষকরা আছেন, এজন্যই সমাজ সুস্থতার আলো দেখেছে। যুগ যুগ ধরেই শিক্ষকরা এটাই করে আসছেন।

প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা দানে যারা নিয়োজিত আছেন তারা সবাই শিক্ষক। দেশে লাখ লাখ শিক্ষক নিরলস প্রচেষ্টায় মহান কাজটি করে যাচ্ছে। এত এত গুণের সমাবেশ ঘটাতে হয় যে একজন অতিমানবেরও বুঝি এত ক্ষমতা থাকে না। সেজন্য শিক্ষকতাকে পেশা না বলে সেবা বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের অবস্থা দেশে খুব একটা সুবিধার নয়। একজন শিক্ষককে বলা হয় আজীবন ছাত্র। জ্ঞান অšে¦ষণে তার তৃষ্ণা অপরিসীম। নিজে না শিখলে অন্যকে কী শেখাবেন। তাই তো তাকে পড়তে হয়, জানতে হয় এবং জানাতে হয়। জানানোর কাজটি হচ্ছে শিক্ষকতার জীবনের সব থেকে পরিশ্রমী এবং কঠিন কাজ। কারণ তার জানানোর কাজটি সফল হয়েছে কিনা তা বুঝতে পারাও একটি বড় দক্ষতার ব্যাপার।

দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত শিক্ষক যেমন আছে পাশাপাশি আছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরিরত শিক্ষক। সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষকের পাশাপাশি দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানে নিয়োজিত শিক্ষকের সংখ্যা প্রচুর। আবার নন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনের উৎসও প্রাতিষ্ঠানিক। সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক না কেন প্রতিটি শিক্ষকের দায়িত্বই একজন শিক্ষার্থীকে মানুষ করে গড়ে তোলা। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্যই এক ও অভিন্œ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আয়ের মূল উৎস হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বেতন, প্রাইভেট বা কোচিং ইত্যাদি।

প্রাইভেটের ওপর নির্ভর জীবন যে কতটা দুর্বিষহ তা কেবল ভুক্তভোগী শিক্ষকরাই জানেন। কারণ প্রতিষ্ঠান থেকে যে বেতন দেয় তা প্রায়ই যৎসামান্য। শহর ও মফস্বল অঞ্চলভেদে এই বেতনের হার কম বেশি হয়ে থাকে। তবে যাই হোক প্রাইভেট বা নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক হোক তিনি একজন শিক্ষক এবং তিনি শিক্ষাদানের মতো মহৎ একটি পেশায় নিয়োজিত। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যেই এসব শিক্ষকের করোনাকালে জীবন ধারণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু কিছু সংবাদ চোখে জল এনে দেয়। নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। সেই অর্থ তাদের মধ্যে দেওয়া হয়েছে। এই দুঃসময়ে এই উদ্যোগ তাদের কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত করবে আশা করি।

কিন্তু কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা এখনো দুর্দশায় আছেন। স্কুল বিক্রি করার মতো সংবাদও পত্রিকায় পড়তে হয়েছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দীর্ঘদিন না দিতে পারা, স্কুল ভবনের ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে না পেরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেউ কেউ। আবার শিক্ষকতা না থাকায় মৌসুমি ফলের ব্যবসার খবর বা অন্য ব্যবসার খবরও পড়েছি। এই মানুষগুলো খুব কষ্টে আছেন। এই সময়ে তাদের জন্য কোনোভাবে সাহায্য করা যায় কিনা তা দেখা প্রয়োজন। এই শিক্ষকগুলোও দেশের লেখাপড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে এদেরও ভূমিকা রয়েছে। এদের দুর্দশা ঘোচাতে কিছু করা প্রয়োজন। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা তাদের দুর্দশা জানাতে মানববন্ধন করেছে। রোজার ঈদ এবং কোরবানির ঈদ কোনো ঈদেই তাদের মুখে হাসি ছিল না। আশা করি এ দুঃসময় দ্রুত কেটে যাবে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উল্লেখযোগ্য হারে কমছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময়। সম্প্রতি এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বলা হয়, যদিও মনে হতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময়ে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে নিজেদের পড়াশোনার সময় বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু গবেষণায় উঠে এসেছে, বাড়িতে শিক্ষার্থীদের নিজেদের পড়ালেখার হার কমেছে অনেকটাই। অথচ টেলিভিশনে ক্লাস নেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যেন অংশগ্রহণ করে তাদের ক্ষতির মাত্রা কমাতে পারে। নিজেরা লেখাপড়ার মধ্যে থাকতে পারে। আমাদের এই পরিকল্পনা সার্থক করে তুলতে হবে।

আপাতত এই ব্যবস্থা শ্রেণি পাঠদানের বিকল্প হিসেবে উপযুক্ত করে তোলার প্রয়াস করতেই হবে। এই কার্যক্রমের সফলতার জন্য কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে শহর ও গ্রামের অভিভাবক সচেতনতা। শহরের অভিভাবকরা সচেতন হলেও গ্রামে সেই হার কম। তাদের আর্থিক অবস্থা, পারিপাশির্^ক সমাজব্যবস্থা এজন্য দায়ী থাকে। ফলে শহরের ছাত্র-ছাত্রীরা টেলিভিশনে ক্লাস করার সুযোগ গ্রহণ করলেও গ্রাম পর্যায়ে কতজন শিক্ষার্থী এ সুযোগ নিতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে শিক্ষক সামনে থেকে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেখানে তাকে শ্রেণিতেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে নানা রকম প্রচেষ্টা করতে হয়।

টিউশন ফি নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সময়টা এমন যে, এখন উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অনেক মধ্যবিত্ত অভিভাবক আছেন যাদের করোনাকালে চাকরি নেই অথবা অর্ধেক বেতনে পরিবার চালাতে হচ্ছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বেতন আদায় না থাকায় তাদের শিক্ষক কর্মচারী এবং অন্যান্য খরচ নিয়ে সংকটে রয়েছে। এমতাবস্থায় কোনো দূরত্ব সমাধান ডেকে আনবে না। বরং উভয় পক্ষকে বসে সমাধান করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা হবে বেশি। অভিভাবকদের দাবি এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের পাওনা এ দুই বিষয়ে সমন্বয় হতে হবে। অনেকেরই পুরো বেতন পরিশোধ করার সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই। এ দিকটি বিবেচনা করতে হবে। করোনাকালীন দুর্যোগ একসময় কেটে যাবে। শিক্ষার গতি আবার স্বাভাবিক হবে। মাঝখানে সময়টা পার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং অভিভাবকদেরও টিকে থাকার সুযোগ দিতে হবে। এ দুইয়ের সমন্বয় করেই আমাদের সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

অলোক আচার্য : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper