ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দেশপ্রেমের সুলুকসন্ধান

সালেহা চৌধুরী
🕐 ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৬, ২০২০

দেশপ্রেম নামের শব্দ দুটো নিয়ে ভেবেছি অনেক। বুঝতে চেয়েছি নিজেকে প্রশ্ন করে আসলে দেশপ্রেম বলতে কোন বিশেষ ভাবনা আমাদের মনে কাজ করে? মনে হয়েছে মধুসূদনের ‘কপোতাক্ষ নদ’ দেশপ্রেমের কবিতা। প্রবাসে নদীর স্মৃতিতে কি থাকে দেশপ্রেম? যে বোধ ছল ছল ও সুগভীর। না হলে রক্তস্রোতের আবহমানের দায়ভারেই কি থাকে দেশপ্রেম? পথ চলতে চলতে হঠাৎ কোনো সুরে সচকিত, পা আটকে যায় মাটিতে। আমাদের সারা শরীর উন্মুখ দেশের ভাবনায় এই কি দেশপ্রেম? মনে যখন জাগে বিশুদ্ধ বেদনা ফেলে আসা একটি কবরী বা কৃষ্ণচূড়ার গাছের জন্য, এই কি দেশপ্রেম? আবার যখন টেলিভিশন শুনতে শুনতে পশ্চিমের কোন এক নেতাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি কারণ এই ক্রিসমাসে তিনি আমার দেশের সব ঋণের সুদ মওকুফ করেছেন সেটাই কি দেশপ্রেম? দেশ যখন খেলায় জেতে আনন্দে ফেটে পড়ি। দুপুরের ঘুম, ইলিশ মাছ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান এরাই কি দেশপ্রেমের আর এক নাম নয়? এমনিভাবে যখন দেশপ্রেম বুঝতে চেয়েছি তখন ঘটল একটি ঘটনা। অনেক রাতে বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে গেলে টেলিভিশনে একটি পুরনো সাদা কালো ইংরেজি ছবি দেখার পর মনে হলো আসলে এই সিনেমায় যে ঘটনা ঘটল তাই দেশপ্রেম।

গল্পটি ওয়েলস-এর পটভূমিকায়। সকলে বলে ওয়েলস-এর লোকজন খুব বেশি দেশপ্রেমিক হয়। ওরা যেখানে যায় কাঁধে বহন করে পর্বত। ওদের চিন্তা ভাবনায় ওয়েলস পর্বতের দার্ঢ্যতা। ডিলোন টমাস ও রিচার্ড বার্টনের মিল নাকি ওইখানে। সুইজারল্যান্ডে নিজের কবরে রিচার্ড বার্টন লেখেন ডিলোন টমাসের কবিতা। ‘ডু নট গো জেন্টল ইন্টু দ্যাট গুডনাইট/ রেভ রেভ এগেনস্ট দ্য ডাইং অব দ্য লাইট।’ প্রাণ ছল ছল হয় এমন কবিতায়, যারা নিঃশব্দে চলে যায় সেই সব মহান মানুষের জন্য।

রাত জেগে, সোফায় দু’পা তুলে, টিমটিমে আলোতে বুঁদ হয়ে যে সিনেমা দেখছিলাম তার গল্পের সারাংশ এই প্রকার। গল্পটির সময়কাল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। একবার ওয়েলস-এর বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতের জরিপ চলছিল। কোনটি পাহাড়, কোনটি পর্বত, কোনটি টিলা, কোনটি উইয়ের ঢিবি তারই ভৌগোলিক জরিপ। একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন সার্ভেয়ার এসেছেন এইসব মাপতে। এইসবের উচ্চতা জেনে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি সার্ভে বইতে এনট্রি করতে হবে। তারা ওয়েলস-এর এক গ্রামে গেছেন। সে গ্রামের পাশে ধ্যানগম্ভীর যে উঁচু জায়গা তা পাহাড় না পর্বত তা জানতে। এক হাজার ফুট হলে সে হয় পর্বত। আর এক হাজার ফুটের কম হলে সে হয় পাহাড়। সেই গ্রামের সকলের দৃঢ় বিশ্বাস তাদের গ্রামে যে উঁচু দেয়াল অতন্দ্র প্রহরীর মতো বছরের পর বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভীকতায় ও বিশালতায়, গ্রামের এক বিশ্বস্ত বন্ধু, ঈশ্বরের মতো শক্তিমান সে অবশ্যই পর্বত, পাহাড় নয়। হিল নয় মাউনটেন। ‘আমাদের গ্রামে একটি পর্বত আছে, যার পাদদেশে আমাদের বাস। পাহাড়ের পায়ের কাছে নয়।’ এমনি ধীরোদাত্ত বাণী উচ্চারণ করতে ওরা ভালোবাসে। এই পর্বত ওদের জীবনের অংশ, যেমন অংশ ঝর্ণা আর গাছপালা। আহা দেশপ্রেমে উদ্বেলিত এক গ্রাম মানুষ। সার্ভে শেষ হল। ইঞ্জিনিয়ার আর সার্ভেয়ার বিশ্রাম করছেন। গ্রামের সকল মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে সেই ছোট হোটেলের সামনে জানতে সার্ভে বইতে তারা কী লিখবে?

-এক্ষুনি বল এটি পাহাড় না পর্বত? শতাব্দী পুরনো ওই প্রাচীর একটি মহান পর্বত নয়? গম্ভীর মুখে কেবল সার্ভেয়ার এসে বলে- সরি। এটি একটি পাহাড়। পর্বত নয়। কারণ এর উচ্চতা মাত্র নয়শ’ ষাট ফুট। চল্লি­শ ফুট কম বলে ওকে আমরা পর্বত বলতে পারছি না।

পর্বত নয়? মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রাম মানুষ। এই লজ্জা তাদের সকলের। বলে একজন- কোনো মানুষ লম্বায় ছোট হলে কি তাকে বালক বলা হয়? বড় মানুষ হয় না সে? এ লজ্জা আমরা কোথায় রাখি।

সকল গ্রামবাসী একত্রিত হল এ অপবাদ খ-ন করার জন্য। নানা সভা, নানা দরজা বন্ধ মিটিং। এই লজ্জা বা অপবাদ যাই হোক সমাধানের চেষ্টা। অতঃপর গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং করে তারা ঠিক করলো গ্রামের সকলে মিলে পাহাড়ের ওপর মাটি ফেলে একে আরও চল্লি­শ ফুট উঁচু করবে। চল্লি­শ ফুটের ঘাটতি পূরণ করবে এই দুই সার্ভেয়ার বিদায় হওয়ার আগেই। বলা যত সহজ কাজটি তত সহজ নয়। ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি পাহাড়ে উঠে তার মাথায় ফেলতে হবে। ব্যাগে, বালতিতে, কাঁধে, পিঠে, হাতে নিয়ে রওনা দিল এক গ্রাম মানুষ। প্রথমে মাটি কেটে সেই মাটি নিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের মাথায়। গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা ছেলে মেয়ে বালক বালিকা সকলে শুরু করল অভিযান। আর বিদায়ী ইঞ্জিনিয়ার আর সার্ভেয়ারকে আটকে রাখার যাবতীয় ফন্দিফিকির চলতে লাগল। আর একবার ওদের দিয়ে পাহাড়টিকে মাপাতে হবে, তাই। তরুণ ইঞ্জিনিয়ারকে ভোলাতে গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে সেবাদাসী করা হল। আর একটু বয়স্ক সার্ভেয়ারকে ভোলাতে গ্যালোন গ্যালোন মদ। তাই দাও তাকে। এছাড়া বিগড়ে দেওয়া হলো তাদের গাড়ি। মেকানিক বলল, তিনদিনের আগে এ গাড়ি ঠিক হবে না। বলাবাহুল্য মেকানিক ওই গ্রামের। আর ট্রেন গাড়ি? সে নাকি ওরা দুজন যেদিকে যাবে সেদিকে যায়ই না।

কেবল যায় উল্টোদিকে। ফলে বয়স্ক সার্ভেয়ার মদের নেশায় বিভোর আর ইঞ্জিনিয়ার মেয়েতে। আর পুরো গ্রামবাসী লেগে গেছে মাটি ফেলার কাজে। গ্রামের ধর্মযাজকের বয়স আশির ওপর। মাটি ফেলতে ফেলতে তিনি মারা গেলেন। উপরে উঠতে আর নামতে নামতে এক বালতি মাটি হাতে ঢলে পড়লেন পর্বতের কোলে। তাকে কবর দেওয়া হল পাহাড়ে। এরপর কি শান্তি আছে? ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। ধুয়ে গেল সদ্য ফেলা মাটি। বৃষ্টিতে ত্রিপল মাথায় দাঁড়িয়ে রইল যখন পাহাড় অপেক্ষা করতে লাগল প্রসন্ন আলোভরা দিনের জন্য এক গ্রাম মানুষ। তারপর আবার নতুন উদ্যমে মাটি ফেলা। এবার সার্ভেয়ার আর ইঞ্জিনিয়ারকে যেতে হবে। আর থাকলে চাকরি থাকবে না। গ্রামের সকলে ধরল আরেকবার পাহাড় মাপতে। তারা প্রথমে রাজি হয়নি। শেষপর্যন্ত সেই সুন্দরীর ধিক্কারে চৈতন্য হলো তাদের- দেখতে পাচ্ছ না সারা গ্রাম দিনরাত খেটে কী করছে। আর তোমরা কষ্ট করে আর একবার মাপতে পারছ না। ধিক্কারে না নিজের ভাবনায় তারা আবার পাহাড়টিকে মাপতে রাজি হল। তারপর ঘোষণাÑ আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি এর উচ্চতা এখন এক হাজার পাঁচ ফুট। পর্বতের উচ্চতার মাপে পাঁচ ফুট আরও বেশি। এরপর? আনন্দে খানখান হলো এক গ্রাম মানুষ। গ্রামের মান রক্ষা পেয়েছে। এবার আমাদের লজ্জা চলে গেছে। এ গ্রামের মৌন ঋষি একজন মহিমান্বিত পর্বত- ‘এ মাউনটেন নট এ হিল।’

সিনেমাটি এখানেই শেষ। টেলিভিশন বন্ধ করে আমি ভাবতে শুরু করলাম পেয়েছি আমার প্রশ্নের উত্তর। আসলে এই হল দেশপ্রেম। এই দেশ প্রেমের যথার্থ সংজ্ঞা। যখন একটি পাহাড়কে পর্বত করতে জীবন বাজি রাখে সকলে। মৃত্যু যেখানে কোনো ঘটনাই নয়। আছে কি আমাদের ভেতরে এমনি কোনো দেশপ্রেম? নদীতে চর পড়ছে, দেশ ভরে উঠছে দূষণে ও দূষিত আবহাওয়ায়, নদী হয়ে উঠছে খাল, খাল হচ্ছে ভরাট, পুকুর ডোবা এরপর অন্তর্হিত, বিরান খামার, শূন্য বাগান, গাছ নিধন হতে হতে শালবন হয়ে উঠছে খোলা মাঠ। চলে গেছে অনেক নদী। যাবে আরও। এতে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ওয়েলস-এর এক গ্রাম মানুষের মতো যদি থাকে দেশপ্রেম তাহলে রক্ষা পায় দেশ, সুন্দর ও শ্রীময়তায় ভরে ওঠে অঞ্চল। দেশপ্রেমের গভীর বেদনায় দেশ হয় উর্বর, আবাদি, শ্যামল ও শোভন। ‘দেশপ্রেমের’ এটি কি একটি বড় উদাহরণ নয়? আপনারা কী মনে করেন?

সেই পর্বতটি আজও আছে। এক গ্রাম মানুষের দিনরাতের খাটুনিতে একটি পাহাড় হয়ে গেছে পর্বত।

সালেহা চৌধুরী : প্রবাসী লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper