ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঈদ আনন্দে বিষন্ন মনচাঁদ

রিপন আহসান ঋতু
🕐 ৬:০৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০

বাঁশ বাগানের মাথা গলিয়ে এবার ঈদ আনন্দে যে চাঁদ উঠেছে তা আসলে উঠেছে বিষন্ন এক মনচাঁদ! বলেছি ক্রান্তিকাল-সংকটের কালের কথা। প্রতিদিনকার যাপিত অভিজ্ঞতা কী বলে? শান্তি নেই, স্বস্তি নেই টানাপোড়েনের দিনকাল এরই মধ্যে আমাদের জীবন চলছে।

বাংলাদেশের সব অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ যখন আরও দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তখন নতুন করে বড় দুটি ঝুঁকি আমাদের সামনে এসেছে। একটি আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা, অন্যটি বন্যা। কোরবানির পশু কেনাকাটাও বেশ জমে উঠেছে। পশুর হাটের যেসব ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো আরও উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সতর্কতা উচ্চারণ করে বলা হয়েছে গত ঈদুল ফিতরের পরপর সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। আসন্ন ঈদুল আজহার সময়েও সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা তো বটেই, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও এখন আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, জনপরিসরে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে সংক্রমণ আরও বাড়তেই থাকবে। অথচ আমাদের দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির কাছে ঈদুল আজহা এক আনন্দঘন অনুষ্ঠান। এই দিনে সবাই আপনজনের সান্নিধ্য পেতে চায়। দুই একদিন সময় কাটাতে চায় প্রিয়জনের পাশে। মা পেতে চায় সন্তানকে পাশে, কার্যোপলক্ষে দূরে অবস্থানকারী সন্তান-সন্ততি তাই ছুটে আসে মায়ের কাছে। ভাই বোনের কাছে, বোন ভাইয়ের কাছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে ছুটে আসে। ঈদের দিনে ভাগাভাগি করে এই দিনের খুশিকে।

ঈদের জামায়াতে ছোট-বড় হাত ধরাধরি করে শরিক হয়। ঈদের নামাজ শেষ করে উষ্ণ কোলাকুলিতে প্রাণের আবেগ বিলিয়ে দেন সবাই। মুরব্বিদের সালাম জানিয়ে আনত দৃষ্টিতে তাদের স্নেহে ভাগ বসায়। মুরব্বিরাও আপনজনদের বুকে জড়িয়ে অনুভব করে এক বেহেশতি সুখ। সমাজব্যাপী ঈদের দিনের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে স্নেহ-প্রেমপ্রীতি অঝোরধারায়। প্লাবিত করে সমাজ জীবনের দশদিক। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপে পুরো বিশ্বের চিত্র এখন বদলে গেছে। দেশে দেশে কঠোরভাবে মানা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব, চলছে লকডাউন। সম্ভাষণ আর উষ্ণ কোলাকুলির জায়গা দখল করে দূরত্বের ডালা সাজিয়ে আসছে ঈদ আনন্দ। মানবিকতার চিত্রও এখন লুপ্ত প্রায়।

এ দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা আঁতকে ওঠার মতন। করোনাক্রান্ত সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছে সন্তান। মুমূর্ষু রোগীকে রাস্তায় নামিয়ে চলে গেছেন অ্যাম্বুলেন্সের চালক। মৃত্যুর পর পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফনে বাধা দিয়েছেন প্রতিবেশীরা। সন্তান ও স্ত্রী সারা রাত লাশ পাহারায় ছিলেন অনেক অনুরোধ-অনুনয়েও কেউ এগিয়ে আসেননি এমন খবরও আমরা দেখছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে দাফন করা নিয়ে জটিলতার খবর নিয়মিতই শুনছি আমরা।

অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৃতদেহ করোনাভাইরাস ছড়ায় এমন কোনো নজির পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দাফন বা সৎকারে অংশ নিলে সংক্রমণের আশঙ্কা নেই। বিভিন্ন স্থানের বিচ্ছিন্ন এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় আমাদের মধ্যে অসহায়বোধ গভীরতর হচ্ছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এমন ভয়াবহ মহামারি আসে একশ’ বছরে একবার। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজের দায় বোধের জায়গা হতে নিজেকে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে রেখে যেতে চাইলে আমাদের উচিত মানবিক আচরণ করা, মানুষের পাশে সহায় হয়ে থাকা। কিন্তু এ দেশে সাহেদের মতো মানুষদের তো অভাব নেই। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কিছু ব্যক্তি এই অসহায় মুহূর্তেই গড়ে তুলেছেন সীমাহীন বিলাসী জীবনের উপযোগী ঐশ্বর্যের চোখধাঁধানো সৌধ। তারা বসবাস করছেন গ্রিক দার্শনিকের ‘স্বপ্নরাজ্যে’। সেই স্বপ্নরাজ্যে ‘মাছেরা নিজেরাই ছুটে আসে, নিজেরাই নিজেদের সেঁকে-ভেজে সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে ভোজনবিলাসীদের টেবিলে নিজেকে পরিবেশন করে থাকে।’

এসব মহামানবের জন্য আসলে প্রতিদিনই ঈদের দিন। তারা কিন্তু এ সমাজে ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা ভিন্ন এবং তারাই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের জন্য বছরে একবারই ঈদ আসে। তাদেরই প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয় আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের। তারাই ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দার শিকার। তাদেরই সহ্য করতে হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হ্রাসের বিভীষিকা। তারাই বেকারত্ব ও আধা-বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত। কর্মসংস্থানের অপর্যাপ্ততা তাদের জীবনে টেনে আনে অন্ধকার রাত্রির অনিশ্চয়তা। এত অসুবিধার মধ্যেও ঈদ এল।

রাজনীতিবিদের দুর্নীতি, আত্মম্ভরিতা, বাচালতা আর নিষ্ফল আস্ফালনের মধ্যেও ঈদ এল। ঈদ এল সেই নির্মম সমাজে অবিন্যস্ত ব্যবস্থাপনার ভাঙা ঘরে। যেখানে এই মহামারির সময়ও পশুর হাটে চলছে গরু কেনার প্রতিযোগিতা। বাহারি গরু কিনতে বিত্তবানরা অকাতরে টাকা ঢালছেন। আর সেই গরু হাট থেকে বাসায় নিয়ে এসে আয়োজন করা হচ্ছে প্রদর্শনীর। কে কত বড় গরু কিনেছেন। কার গরুর কত দাম তা নিয়েই চলছে আলোচনা।

আলোর নিচে যেমন অন্ধকার, তেমনি স্বাস্থ্যবান এই পশুর দিকে তাকিয়ে থাকে লিকলিকে মানবসন্তানও, সে হয়ত চোখে অন্ধকার দেখে। কারণ তার চেয়ে দেখাই সার। মাংস তার কপালে জুটবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কারণ পশু কোরবানির যে নিয়ম তা অনেকেই ভুলতে বসেছেন। যদি ভুলেই না যেত তাহলে কোরবানির আগে দেশজুড়ে বিশাল আকারের ডিপ ফ্রিজের বিক্রি এত বেড়ে যেত না। গরিবের হক, প্রতিবেশীর হক হয়ত জমা হবে ডিপ ফ্রিজে। বর্তমান সময়টা সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য বড় অস্থির।  FoMo ev Fear of Missing out খুব বড় কলকাঠি আমাদের অজান্তেই নেড়ে চলেছে। আমরা কোনো কিছুতেই পিছিয়ে থাকতে চাই না।

তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় চলতে থাকে আনন্দের মুহূর্ত আপলোড। সেটা গরুর সঙ্গে হোক অথবা কোনো রামছাগলের সঙ্গে। আপলোড চলুক। এ তো আনন্দেরই ব্যাপার। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এত আপলোড করেও ইনবক্সে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েও তো মনে হতে থাকে কী যেন কম হয়ে গেল। সারাদিন প্রিয়জনদের সঙ্গে সুসময় কাটিয়েও মন বলতে থাকে, এর বেশিও তো সম্ভব ছিল! হয়ত ছিল। কিন্তু যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দের সঙ্গে কাটছে আপনার ঈদ, হতেও তো পারে সেটাই অনেকের জন্য কাক্সিক্ষত ছিল! কিন্তু সেটার ছিটেফোঁটাও হয়নি তাদের। কোরবানির ইতিহাস ত্যাগ ও মহিমার। ইসলাম ধর্ম মতে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তার শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। আল্লাহ তার কোরবানি কবুল করে নেন। ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানি হয়ে যায় পশু।

আর এই পশু কোরবানি একটি উপলক্ষ মাত্র। এর মাধ্যমে মনের পশুকে কোরবানি দিতেই বলা হয়েছে। মনের সব পাপ, অসততা, জরা কোরবানিই হল আসল কোরবানি। আমি হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশে ঈদুল আজহায় যত পশু কোরবানি হয় তা যদি ইসলামের রীতি অনুযায়ী বিলি বণ্টন করা হয় তাহলে ষোল কোটি মানুষ সবাই অন্তত একবেলা তৃপ্তির সঙ্গে খেতে পারেন। আর কোরবানির মূল আদর্শের কথা তো বাদই দিলাম। আমরা যদি সেই ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত হতে পারতাম তাহলে সমাজে হিংসা, হানাহানি থাকত না।

বেশি লাভের আশায় কৃত্রিমভাবে কোরবানির গরুকে ওষুধ খাইয়ে মোটাতাজা করে প্রতারণা করতেন না ব্যবসায়ীরা। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে কাউকে জীবন দিতে হত না। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে হত না বন্দুকযুদ্ধ। আর কালো টাকার প্রতিযোগিতায় সাম্যের উৎসবে অসাম্যের প্রকাশ ঘটত না। তবুও আশায় বুক বাঁধি, প্রকৃত কোরবানির আদর্শে একদিন উজ্জীবিত হবেন আমার দেশের মুসলমানরা; সাম্য আর ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে ঈদের আদর্শে।

 

রিপন আহসান ঋতু : কথাসাহিত্যিক ও সংগঠক

[email protected]

 
Electronic Paper