থমকে গেছি চমকে উঠব কবে
ইমরুল কায়েস
🕐 ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০
মাঝে মাঝেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। যেন দম আটকে যায়। থমকে গেছে জীবনঘড়ি, চলছে কোনো রকমের চার্জ ফুরোনো ব্যাটারির দুর্বল শক্তিতে। চলমান জীবনের দিক নির্দেশক কাঁটাগুলো আস্তে আস্তে করছে শুধু টিকটিক। প্রখ্যাত কথাচিন্তক হুমায়ুন আজাদ বলে গিয়েছেন ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’; একটি বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’! তার সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভবিষ্যদ্বাণী কি আমরা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না? পাচ্ছি; শুধু ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে নিজেই নিজের মধ্যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকছি।
এ যেন হিমশীতল রক্তের প্রাণী হয়ে ব্যাঙের মতো সহস্র বছরের শীত নিদ্রা! সত্যিই থমকে গেছি। কবে যে চমকে উঠব! সেই দিন গুনছি।
স্থবির চিত্তে এখন বারবার অতীত স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি। করোনায় মানুষের লোভী মন কেমন করে অসুখ নিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে! মানুষের বিশুদ্ধ অনুভূতিগুলো এত ভোঁতা হয়ে গেল কেমন করে? করোনায় তো জীবন প্রদীপ নিভু নিভু তার ওপরে প্রতারক মানুষগুলো আর একটি জীবন হন্তারক হয়ে এলে সাধারণ মানুষের কোথাও যাওয়ার আর লুকানোর জায়গা থাকে না। তখন বারবার ফেলে আসা সুন্দর সুন্দর সুখস্মৃতি আর হারিয়ে যাওয়া আখরগুলোকে রোমন্থন করে বর্তমান সময়টাকে একটু হলেও স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা বই আর কিছুই না। তবে কাজ একটা হচ্ছে, নিজেকে আবার আত্মপরিচয়টাকে বারবার আলিঙ্গন করা। মন বারবার চলে যাচ্ছে ফেলে আসা মাঠে যে মাঠের প্রত্যেকটি মাটি কণা মায়ের আদরের মতো শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে।
ফিরে যাই সেই কাজিয়ার মাঠে। মাঠের এককোণে ছিল বড়ো একটা শিমুল গাছ। সেই গাছে না ছিল কোনো পাতা শুধু লাল লাল ফুল। আহা রে! সেই লাল ফুলে ঠিক দুপুর বেলা সূর্য যখন মাথার ওপরে খাড়া; কড়া রোদের ঝকমকি, সঙ্গে মেঘের সাদা রঙয়ের মাঝে মনে হত গাছের শাখায় আগুন লাগছে। গাছের নিচে ধপাধপ পড়তো লাল ফুল। গাছের নিচটা ভরে যেত এমন করে যেনÑ লালের সমুদ্রে পা মেলে হাঁটছি। আর ফেরা হয়নি সেই লালের গালিচায়, সেই গাছের চ্যাপ্টা শিকড়ের গর্তে মাথা এলিয়ে পা ছড়িয়ে রাজার মতো শুয়ে থাকা। আর চাইলেও হবে না; কারণ জীবনের নানা বেড়াজালে বন্দি পরাজিত রাজা আমি।
সেই মাঠের অনতিদূরে ছিল একটি বড় কুড়া। বানের পানি আর বর্ষার পানি জমে থাকতো সব সময়। রাস্তার মাঝখানে এই কুড়া। এই কুড়াকে নিয়ে মুখরোচক নানা কথা গ্রামময় ছড়িয়ে আছে। অনেকে বলে মাষানি কুড়া; এর জলে নামলে পা টেনে ধরে গভীরে নিয়ে যাবে আর পানির নিচে নিয়ে পা ওপরে তুলে মাথা কাদার মধ্যে চুবিয়ে ধরে মেরে ফেলবে। আবার কেউ কেউ বলে এখানে মাইন ছিল একদিন ব্লাস্ট হয়ে এমন বড় গর্ত হয়েছে আবার অন্য একদল বলে ইংরেজ আমলে এখানে ম্যাগনেটিক পিলার ছিল। একদিন রাতে কালোবাজারি ও পিতল স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এসে দলবলে খুঁড়ে খুঁড়ে এই অবস্থা করেছে। আমরা তো ছিলাম দশ থেকে বারোজনের নিয়মিত দুষ্টুকুল পঙ্গপালের শিরোমণি।
কুড়া নিয়ে এত মাতামাতি বা কৌতূহলের ধার ধরার কিছু ছিল না। কুড়াটা খেলার মাঠ মানে ঐ কাজিয়ার মাঠের কাম সুইমিং পুল হিসেবে আমাদের কাছে ব্যাপক কদর ছিল। তবে সব ছোকরাদের মনে মাষানের হাতে পড়ার ভয় বুকে ঢিবঢিব করত। কেউ কাউকে বুঝতে দিতাম না। তবে যত উৎসাহে কুড়ার পানে দৌড়ে সবাই আসতাম কাছে এসে হাইড্রোলিক ব্রেকের মতো থেমে যেতাম কে আগে নামবে। কারণ ঐ একটাই মাষান ভীতি! তো আমাদের মধ্যে ছিল অতি সাহসী গোলজার মামু। মামুর আবার একটা পা খোঁড়া ছিল।
গ্রামে আবার সবাই ডাকত খোঁড়া গোলজার বলে। কেন জানি, এমন মানুষগুলো নির্ভয় আর দুর্দান্ত সাহসী হয়। কুড়ার কাছে গিয়ে ওই মামু ডিগবাজি দিয়ে এমন লাফ দিত, মনে মনে ভাবতাম এই তো মাষান! এর পা দেখে মাষানই ভয় পাবে। তো পরে একে একে সবার বিরতিহীন ডিগবাজি চলত। কাজিয়ার মাঠে ভরা রোদে ফুটবল, ক্রিকেট খেলা শেষে ক্লান্ত শরীরে শিমুল গাছের শেকড়ের খোলসে রাজার মতো বিশ্রাম শেষে কুড়া কাম সেই সুইমিং পুলে লাফ-ঝাঁফ চলত।
একটা বিশেষ প্রতিযোগিতা চলতো চোখকে ডিপজল চোখ বানানোর। কার কত বেশি লাল হয়ে চোখ কোঠর থেকে ডিপজলের মতো উপচে পড়বে। তো কে কার চেয়ে বেশি লাল করতে পারে এ নিয়ে আর ওঠার নাম থাকত না। চোখ লাল আর গায়ের চামড়ায় পানির ময়লা লেগে একটা আলাদা সাদা আস্তরণ পড়ত। ঠিক জাল ধরে দীর্ঘক্ষণ মাঝিরা মাছ ধরলে যেমন হয় তেমন। তবুও তাই ভালো লাগত জীবন বড়ই মনোহর ছিল বটে।
এখন গরম পানি, ঠাণ্ডা পানি বা শাওয়ার ছেড়ে বা ঝরনায় আরো আয়েশি বাথটাবে সারাদিন শুয়ে থাকলেও ওমন সুখ আর চোখ লালের মজা হয় না। না পাই শান্তি; না আসে তৃপ্তি। করোনাকালে অফিস থেকে ফিরে গরম পানি দিয়ে গোসল করলে গা আরো বেশি জ্বলে। কিন্তু ঐ ফেলে আসা সময়ে চৈত্রের কড়া রোদে কাজিয়ার মাঠে প্রাণ ছেড়ে ছোটাছুটির পরে সেই কুড়ায় গিয়ে নামলে ওপরের পানি মনে হত এত গরম যেন মাংস পুড়ে হাড় বের হয়। একটু একটু করে যখন পানির নিচে গভীরে ডুবে যেতাম যতই পানির ভেতরে যেতাম ততই শীতল পানির ঠাণ্ডা আদরে শরীর জুড়াত।
এখন ঢাকার গরম পানির পরে কেন এমন হয় না। বারবার গোসল আর ঠাণ্ডা বা গরম পানি ঢাললেও আর ক্লান্তি কমে না। সেই গোসল কি আর এ জনমে হবে? না হবে না। কারণ হয়ত গ্রামে গিয়ে দেখবো কুড়াটা আর নেই। তার জায়গায় কংক্রিটের একটি ব্রিজ; দু পা দুদিকে মেলে মাঝখানে আমাদের মধুর স্মৃতির মাটিগুলোকে চাপ দিয়ে ধরে বসে আছে! তাছাড়া সেই পানির সাদা ময়লা কি এখন গায়ে লাগানো মানায় এখন তো আমি অফিসার! ওমন সুখ বিলাস আর এ জনমে জুটবে না। যে অতীত হারিয়েছে কালের খেয়ায় তা এখন শুধুই কলমের ডগায় আর চোখ বন্ধ করলে ফিরে আসে। এতে যতটুকু প্রাণের তিয়াস মেটে ওতে সই।
আম তো এখনো খাই, তখনো খেতাম। ঐ যে কিন্তু অমন আমের স্বাদ আর পাই না। শহরে আমের কোনো ঘ্রাণের বালাই নাই। সেই বাল্যকালে গাছের মগডালে উঠে সিন্দুর মাখা আম পেড়ে নিচে ছোট বোনের জামার প্যাঁচানো থলেতে রাখা। কাঁচা আমের বোঁটা ভেঙে আঠা মুখে আর ঠোঁটে লেগে ঘা হওয়া। কাঁচা আমের সঙ্গে শুকনো মরিচ গুড়া আর তপ্ত দুপুর বেলা! বড় বড় আমের গাছ তখন মনে হত দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দৈত্য মনে হত কারণ, আমি তখন পুচকিটি। তখন গাছ বড় ছিল আমার সময় অফুরন্ত আর এখন আমি বড়, প্রিয় গাছগুলো ছোট হয়ে গেছে সঙ্গে ওদের সঙ্গে বুক লেপ্টে উঠা সময়টা আরো বেশি করে ছোট হয়ে পড়েছে। তাই ছোট গাছে আর উঠতে স্বাদ জাগে না।
সময়ের সঙ্গে ফুলগুলোও কেমন বদলে গেছে। এখনো অনেক ফুল কিনি। প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার ফুলের দোকানে যাই। কিন্তু ফেলে আসা তখনকার মতো ফুল কেনার ফুরফুরে শিহরণ জাগে না। এখন পকেট ভারি অনেক ফুল কিনতে পারি তখন পকেট পাতলা ছিল হয়ত কোনো রকম একটা লাল গোলাপ বা একটা রজনীগন্ধার স্টিক এই শেষ। সেগুলোর দাম পাঁচ টাকা থেকে দশ টাকা আর হাতের সামনে না নিয়ে পেছনে দুহাতের মাঝে নিয়ে বোকার মতো হেঁটে যাওয়া তবু সময় কাটে না আর সে আসে না তবুও এতটুকু বিরক্ত লাগে না। সেই একটি ফুল না জানি কত দামি ছিল কাক্সিক্ষত হাতে ফুলটি পৌঁছানো অবধি বড়ই রতœতুল্য। আহা সেই জীবনের এত রঙ এখন একরঙা।
জীবনে মনের ঢেউয়ে ঢিল ছোঁড়া প্রথম কাউকে ফুল দেওয়ার জন্যে ফুল কিনে হাতে ধরে থাকার অনুভূতি এখন শত শত সাত বাহারি ফুল কিনে হাতে ধরে থাকলেও সেই নাড়া দেয় না। আর হবেও না। ফুল কি তাহলে বদলে গেল? না সময়ের সঙ্গে জীবনের বিশুদ্ধ অনুভূতি নেওয়ার স্নায়ুগুলো কেমন জড় হয়ে পড়েছে। ফুল তার রঙ আর সুবাসে ঠিকই আছে শুধু জীবনের রঙ গানের মতো বদলে গেছে এ জীবন কেন এত রঙ বদলায়...।
আর ভাল্লাগে না...! কয়েকদিন আগে মনের সুখে বাজার করতে যেতাম। বাজার করতে বরাবরই ভালো লাগত। অথচ এখন ভয়ে বাজার যাই না। অতি দরকারে গেলে গায়ে গা লাগার ভয় থাকে। মাছ, শাক-সবজি হাত দিয়ে ধরা হয় না। সাবধানে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিই। কয়েকদিন আগেই তো মাছের সুন্দর রৌপ্য ঝলমলে গা টিপে টিপে ধরে ভালো মাছটি পরিবার-পরিজনের জন্য নিয়ে আসতাম। আলুর গায়ে লেগে থাকা মাটি মুছে মুছে ভালো আলু বেছে নিতাম। শাকের আঁটি ঝেঁকে ঝেঁকে লাল শাক, পুঁই শাক কত রকমের শাক বাজার করতাম। এখন ধরি না। পলিথিনে মুড়ে নিই। প্রিয় শাকসবজিগুলোর পাতা পলিথিন থেকে উঁকি দেয়। আহা মানব জনম গেল খাইতে আর নাইতে!
জীবন গেল খাই খাই আর চাই চাই করতে করতে। নিজেকে ভাবতে আর জানতে কই পারলাম। এখন দামি এসি হোটেল-রেস্তোরাঁয় চাইনিজ-ফাস্টফুড, কাচ্চি বিরিয়ানি কত কী খাই। কিন্তু তখনকার মতো সেই অনুভূতি কেন আসে না।
দুই টাকার বাদাম-বুট নিয়ে চার পাঁচ জন বন্ধু মিলে স্কুলের মাঠে গোল হয়ে বসে আড্ডা দেওয়া ওমন সুখ আর লাগে না তৃপ্তি মেলে না। দুই ভাইয়ে বাইসাইকেল চড়ে গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা ধরে সাইকেলের সিট পাই না তবু নিচে পা দিয়ে কষ্ট করে চালানো, ছোট্ট ভাইটিকে পেছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে নেওয়ার অবিনিময় যোগ্য আনন্দ এখন কই গেল? এখন তো পিচঢালা রাস্তায় নিজে দামি গাড়ি চালিয়ে পেছনে সেই আদুরে ভাই আর তার বউকে বসিয়ে ভ্রমণ করি। কই সেই সময়ের মতো আনন্দ লাগে না। অফিস থেকে ফেরার পথে কাউকে না কাউকে পেছনে নিয়ে বাসায় আসি বা কাছাকাছি নামিয়ে দিই। কিন্তু এখন কেন পারি না? করোনাভয়ে এখন কোনো মানুষ বা প্রিয় কাউকেই বসাতে পারি না। জীবন কেন এমন হল?
সত্যিই থমকে গেছে; জীবনে কমে গেছে পরিসর। মুক্ত পৃথিবীকে জেলখানার চেয়েও কষ্টের কারাগার মনে হচ্ছে। সব কিছুতেই থমকে আছি। কবে খুব সকালে ঘুম ভাঙলে শুনতে পাব করোনা নির্মূল! তখন সবচেয়ে বেশি চমকিত হব। চমকে উঠবে মানুষ। প্রতিটি মানুষ ওইদিন এমন হাসি দেবে যা বাকি জীবনের সকল মানুষের সেরা হাসি হয়ে থাকবে। সেই সেরা হাসিটি দেখতে চাই! এমন পরিসর বিহীনজীবন কারোই ভালো লাগার কথা না। কোথাও তৃপ্তি নেই; শুধু ভয় আর একপ্রস্থ হতাশা, সঙ্গে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা।
এখন প্রতিটি মিনিট বেঁচে থাকার জন্য কিনতে হচ্ছে জীবাণুনাশক আর স্যানিটাইজার। এমন করে আর কতদিন চলবে? ক্ষণে ক্ষণে শুধু করোনার ভয়। এই বুঝি পাশের জন মারা গেল বা নিকট কারো করোনা হওয়ার খবর এল! চলে না এমন করে; নিত্য প্রতারণার মাঝে জীবন; সুন্দরের জয় গান গাইতে পারে না।
ইমরুল কায়েস : গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তা