ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকব কতকাল!

সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০

‘পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করো’ প্রবাদটি সেই শৈশব থেকে আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত। শিশুদের পাঠ্যবইয়ে অমন ধরনের প্রবাদ নিয়ে রচনাও দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার কতটুকুইবা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে সক্ষম হই! রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের করোনাভাইরাস টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের ব্যাপারটা যখন থেকে জনসমাজের সম্মুখ খোলাসা হল, ঠিক তখন থেকেই শুধু এই একটা দুর্নীতির অপকর্ম নিয়ে আমাদের মধ্যে চরমভাবে সমালোচনার চর্চা শুরু হয়।

একে নিয়ে চললো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলসহ নানান মন্তব্যের ছড়াছড়ি। অপরদিকে, জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফকে নিয়েও এক প্রকার লঙ্কাকা- হয়ে গেল। নীতিবিরোধী কার্যকলাপ কি শুধুই ওদের দুজনের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ? এরকম অসংখ্য খাতে হাজারটা সাহেদ-সাবরিনা গা ঢাকা দিয়ে জনসম্পদকে লুটপাট করে চলছে হরহামেশাই। অনিয়মগুলোর মধ্যে প্রতিবছর আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি অন্যতম। সরকারের অর্থ শাখার বর্তমান নেতৃবৃন্দ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বলে আসছেন, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না।

কিন্তু বাস্তবতা পুরোটাই বিপরীতে। ২০১৮ সাল শেষে যেখানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছেÑ প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের প্রাক্কলিত হিসেব অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি।

ফলে অর্থনৈতিক সেক্টরে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তাদের আস্থা প্রতিনিয়ত কমে আসছে। শুধু তাই নয়, দেশে রাজস্ব ঘাটতির মতো সমস্যা সৃষ্টি হলে অবকাঠামোগত বরাদ্দ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। যার প্রভাব পড়বে প্রবৃদ্ধিতে। দুর্নীতি সূচকে এখনও বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর ভেতরে অবস্থান করছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণা সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড পুরনো কথা। ২০১৬ সালের দিকে ১৬তম অবস্থানে দাঁড়ালেও এখন পর্যন্ত সংখ্যাটা এর আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

সংস্থাগুলো দুর্নীতি সূচক ধারণা প্রকাশ করে নানান খাতে অনিয়ম পর্যালোচনার পর একটি স্কোর প্রদানের মাধ্যমে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাকে নীতিবাক্য তৈরির কারখানা বলা হয়, সেগুলোই যেখানে নিস্তার পায়নি সেখানে অন্যান্য স্তরগুলোকে দুর্নীতি থেকে নিরাপদ রাখাটা এক অর্থে দুঃসাধ্য ব্যাপার। মানুষ গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুদায়িত্ব পালন করে অথচ আমাদের শেখা ও কাজের মধ্যে কোনো মিল নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়ে টেন্ডারবাজি শব্দটির সঙ্গে আমরা পূর্বপরিচিত। গত বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভিসি খেদাও’ আন্দোলন তার নিকৃষ্টতর উদাহরণ!

জাতীয় বাজেটের ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। সেই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সুশাসনের অন্যতম দিক ‘স্বচ্ছ জবাবদিহি’ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর। দরপত্র ছিনতাইসহ ই-টেন্ডার নীতিমালা উপেক্ষার বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নাসির উদ্দিনকে অপসারণের সময় স্বজনপ্রীতিসহ অপকর্মের নানান দিক সাধারণের সামনে উন্মোচন হয়েছিল। এছাড়াও শিক্ষকদের শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে অডিও ক্লিপ ফাঁসের কথা প্রায়শই শুনে থাকি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় এর আগে এমন অনেক শিক্ষকের নিয়োগ বাণিজ্যের ক্লিপ প্রকাশ হয়েছে।

যা একটি দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেয়। আবার পুরনো বিভাগগুলোয় শিক্ষক-কর্মচারীর অপর্যাপ্ততা থাকা সত্ত্বেও নতুন বিভাগ খুলে স্বজনদের নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাও অনেক প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে ঘটেছে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে কাজ করবে; এটি একটা সুষ্ঠু সমাজের প্রত্যাশা। শিক্ষা অর্জন করে বড় বড় ডিগ্রিধারী গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সুশিক্ষার অভাব যেন রয়েই যাচ্ছে! যার ফলে দুর্নীতি নামক শব্দের রোষানলে পড়ে রয়েছে দেশের কাঠামো। কিছু কিছু ঘটনা এমন ঘটে যেন ‘সেরের ওপর সোয়া সের’। সরকারি চাকরি দেওয়ার নাম করে এক প্রকার দালাল চক্রের ফাঁদে পা দেয় অনেক শিক্ষিত বেকার। পরবর্তীকালে চাকরি তো দূরের কথা, যে আগাম টাকা প্রদান করে সেগুলোও হারিয়ে বসে।

সুতরাং আমাদের দ্বারা এমন কোনো কাজ যাতে না হয়, সে বিষয়েও খেয়াল রাখা জরুরি। দুর্নীতির চাকায় সবসময় চাপা পড়ে যায় সাধারণ মানুষ। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের দখলদারি চিন্তা-ভাবনার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাদের ওপরে। যেমনÑ প্রত্যেক বছর জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ মোকাবেলায় সরকার নদীর তীরবর্তী ও উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বরাদ্দ দেয়। সরকারের পাশাপাশি বিদেশি সহায়তাও পর্যাপ্ত থাকে। এরপরেও সেসব অঞ্চলের মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। খাদ্য, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদের বাঁচতে হয়। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে দেশে অপচারের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা মনে করবেন না, তারা সরকারের জন্য নয় বরং দেশের জনগণের জন্য কাজ করে ততক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। না হলে শুধু সাহেদ-সাবরিনার মতো অপরাধীকে ধরেই ক্ষান্ত হতে হবে দুর্নীতির শেকড় সন্ধান করে প্রতিরোধ করা সাধ্যকর হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর বিপক্ষে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পরেও এর দৌরাত্ম্য যেন কোনোক্রমেই থামছে না। কারণ, অপরাধ করে পার পাওয়া যায় এমন ধারণা সমাজে এখনো প্রতিষ্ঠিত। আমরা জানি যেকোনো দুর্নীতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধে ক্ষমতাবান ব্যক্তি থেকে শুরু করে একজন দিনমজুরের জন্য আইন সমান।

তা জানা থাকা সত্ত্বেও অন্যায় কাজে লিপ্ত হই, কেননা আইনের সঠিক তৎপরতা না থাকা। অপকর্ম দেখলেই বাধা দিতে হবে। প্রথমেই সমাজ বা রাষ্ট্রের দিকে নয় বরং নিজ পরিবারের সদস্যদের অসৎ উদ্দেশ্য প্রতিরোধ করতে হবে। সে ব্যক্তি হতে পারে নিজের মা অথবা বাবা। মানুষের আত্মবিবেকের সমৃদ্ধিও আসে পরিবার থেকে। একটি শিশুর জন্মের পর তার সামাজিকীকরণে এটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। সামাজিক এই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন পরিবারকে ঠিক করতে পারলে সমাজও রক্ষা হবে। সর্বোপরি একটা সমাজকে বাঁচাতে পারলে সোনার বাংলা গড়া তবেই সম্ভব।

 

সাজ্জাদ হোসেন : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

 
Electronic Paper