ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঈদ এবং সহমর্মিতার স্মৃতি

জেসমিন চৌধুরী
🕐 ৮:২৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৮

ঈদ মুসলিমদের জন্য বছরের সবচেয়ে আনন্দময় দিন, কিন্তু খুব বৈচিত্র্যময় কি? সেই তো একই রুটিন-আগের ১০ দিন রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম বাধিয়ে কেনা কাপড়-জুতোর প্রদর্শনী, ঈদের দিনে, অসুস্থ হওয়া পর্যন্ত খেতে থাকা, পেটে অসুখ বাধিয়ে শুয়ে থাকা।

আজকাল অবশ্য তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাহফুজুর রহমানের পীড়াদায়ক একক সংগীতানুষ্ঠান দেখে মাথা লাটিমের মতো ঘুরতে থাকা। পেছন ফিরে তাকিয়ে যে দুটি ঈদের স্মৃতি খুব বেশি মনে পড়ে তার একটা হচ্ছে, ১১ বছর বয়সের। ঈদ ছাড়া বছরের অন্য সময়ে আমরা নতুন কাপড় পেতাম না একেবারেই। তো, সেবার সাদার ওপর নীল প্রিন্টের নতুন জামা পরে বেড়াতে গেছি ক্লাসমেট সানজিদার বাসায়। ওদের বাসার কাজের মেয়ের পরনে ছিল হুবহু আমার জামাটাই-একই প্রিন্ট, একই রং, একই ডিজাইন। দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না-‘বাহ, একরকম জামা তো শুধু আপন বোনদের হয়, আমাদের কী করে হলো?’  
সানজিদার মা খুব আদর করে সেমাই খেতে দিলেন, সেই সঙ্গে শ্রেণিবিভেদ সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা ‘কর্নেল সাহেবের কি এর চেয়ে দামি কিছু তৌফিকে কুলালো না? আমরা তো কাজের মেয়েদের এমন কাপড় দেই।’ খুব মন খারাপ হয়েছিল, লুকিয়ে কেঁদেছিলাম, কিন্তু আরও একটু বড় হতে হতে বুঝেছিলাম কর্নেল সাহেবের তৌফিকে কেন এর চেয়ে ভালো কিছু কুলোতো না, কারণ তিনি সুবিধাবঞ্চিতদের পেছনেই তার তৌফিককে নিয়োজিত রাখতে পছন্দ করতেন। দ্বিতীয় স্মৃতিময় ঈদটি ছিল ১৫ বছর বয়সে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বড় বোনদের সবার বিয়ে হয়েছে বেশ আগেই, বড় ভাই পরিবার নিয়ে চিটাগাং থাকেন। মায়ের শরীর প্রায়ই খারাপ থাকে বলে বেশ ক’বছর ধরে সংসারের সব দায়িত্ব আমার কাঁধেই।
সেবার পুরো রমজান মাসজুড়েই আমার শরীর খারাপ ছিল। সমস্ত গায়ে বিশ্রী রকমের আর্টিকেরিয়া, চুলকাতে চুলকাতে গায়ের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত হয়ে গেছে, গোসল করতে গেলে পানি লেগে ভয়াবহ রকমের জ্বালাপোড়া করে। যন্ত্রণার চোটে আমিনার মায়ের পরামর্শে সাদা গরু কালো গরুর মূত্রমাখা দড়ি ভেজানো পানিতে গোসল পর্যন্ত করেছি, লাভ হয়নি। ঈদের দিন সকাল থেকেই আমার মন ভীষণ খারাপ ছিল। আগের দিন রাতে দীর্ঘ সময় আগুনের আঁচে থাকার কারণেই বোধহয় চুলকানি অনেকটা বেড়ে গেছে, সেদিকে বাড়ির কারোরই খেয়াল নেই। ঈদ উপলক্ষে বাড়ি আসা ভাই-ভাবী তাদের ছোট বাচ্চাগুলোকে সাজাতে ব্যস্ত, মা মগ্ন আল্লাহ-বিল্লায়, আব্বা ব্যস্ত সামনের বারান্দায় বেঞ্চ পেতে ফকির খাওয়ানোতে। কাজের ছেলে মুসলিম ঈদের ছুটিতে।
আমি অসুস্থ শরীরেই বিশাল টানা বারান্দাটা চটের টুকরো দিয়ে মুছতে লেগেছি, কেউ বারণ করছে না। আমাদের বাড়িতে আদর-আহ্লাদের একটু কমতি ছিল চিরদিনই, অসুখ-বিসুখ নিয়েও কোনো আদিখ্যেতা ছিল না। আমি বারান্দা মুছছি, সেই সঙ্গে অভিমানে ভিজে ওঠা চোখ দুটিও। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, কেউ ভালোবাসে না, আমি খুব একা এবং অসহায়।
ঠিক তখনই পেছনের বারান্দার নিচে এসে দাঁড়াল প্রায় অর্ধ উলঙ্গ এক মহিলা, সঙ্গে নানান বয়সের ছয়টা হাড্ডিসার বাচ্চা। সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটা তার পেটের সঙ্গে ঝুলে বুকের দুধ খাচ্ছে। অন্য একটা বাচ্চা চেঁচিয়ে কাঁদছে, মা ভিক্ষার আবেদন জানাতে জানাতে বাচ্চাটার মাথায় চাটি মেরে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তার কান্নার বেগ ক্রমশই বাড়ছে।
মহিলাটা তার দুঃখের কাহিনী বলল। দিনমজুর স্বামী তাকে ফেলে অন্য একজনের সঙ্গে চলে যাওয়ার পর থেকে ভিক্ষাই তার একমাত্র অবলম্বন। ভিক্ষার টাকায় ভাড়া দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সিলেট এসেছিল কারণ শুনেছিল সিলেটের মাজারে ভিক্ষা পাওয়া যায় বেশি, কিন্তু রাতের বেলা তার পোটলা-পাটলিও চুরি হয়ে গেছে। দুদিন ধরে বাচ্চারা মাজারের হালুয়া-শিন্নি ছাড়া আর কিছু খায়নি।
আমার চোখ আবার ভিজে উঠল, কিন্তু এবার নিজের নয়, পরের কষ্টে। একটু আগে নিজেকে নিয়ে দুঃখবিলাসে মগ্ন হওয়ার লজ্জা আমার বিবেকের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। কিছুটা উদাসীন হলেও আমার মা-বাবা আছেন, অসুখ নিয়ে কাজ করতে হলেও বাড়িতে খাবার আছে, খাওয়ানোর মতো আত্মীয়স্বজন আছে। এই ভিখারি মেয়েটির সঙ্গে নিজের অবস্থার তুলনা আমাকে অস্থির করে তুলল। তাদের পেট পুরে খাওয়ালাম, চাল-ডাল কাপড়-চোপড় যা পারি পোটলা বেঁধে দিলাম।
মেয়েটা যখন খুশি মনে চলে যাচ্ছে তখন আমার মনে হলো, আমি কি এদের জন্য যথেষ্ট করেছি? আর কিছু কি করতে পারতাম? আবার ডেকে দাঁড়াতে বললাম মেয়েটাকে। অনেকদিন ধরে একটা মাটির ব্যাংকে খুচরা পয়সা জমাচ্ছিলাম। সেটা ভেঙে যা পেলাম তুলে দিলাম তার হাতে। এইবার সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আকাশের দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে দোয়া করতে লাগল যেন আল্লাহকে ডেকে মাটিতে নামিয়ে আনবে এখুনি। জীবনে কেউ আমার জন্য এত দোয়া করেনি। তার দোয়ায় অবশ্য আমার খুব একটা আনন্দ হলো না, আল্লাহ যদি তার দোয়া কবুল করতেন তাহলে তার নিজের এই অবস্থা হবে কেন?  
ঈদের ছুটির পর প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই একটা খুশির খবর পেলাম, আমি ক্লাস এইটে দ্বিতীয় গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছি। স্কুল বন্ধ হওয়ার আগেই বৃত্তির ফলাফল বেরিয়েছিল, কিন্তু ভুলক্রমে তালিকায় আমার নামটা আসেনি। সংশোধিত তালিকা এসেছে ঈদের পরে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং করিনি, ঘর-সংসারের চাপে পড়াশোনাই করতে পারিনি, অঙ্ক পরীক্ষা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে, আমার বৃত্তি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। হঠাৎই মনে পড়ে গেল সেই ভিখারিনীর কথা। এরপর দীর্ঘদিন ধরে আমার বিশ্বাস ছিল ঈদের দিনে নিজের অসহ্য শারীরিক কষ্টের কথা ভুলে ওই মেয়েটির জন্য কেঁদেছিলাম বলেই আমাকে অদৃশ্য কোনো শক্তি পুরস্কৃত করেছে।
এখন অবশ্য আমার বিশ্বাস একটু অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। আমি এত খেয়ালি কোনো অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস করতে রাজি নই যে, ছয় বাচ্চাসহ একটা মেয়েকে বিপদের সমুদ্রে ফেলে দেবে যাতে তাকে কৃপা প্রদর্শন করে তার দোয়ায় আমি বৃত্তি পেতে পারি। না, যার অসামান্য দয়া এবং করুণা থাকার কথা, মানুষের জীবন নিয়ে তার এমন ছিনিমিনি খেলার কথা নয়। আমাদের হিসাবে কোথাও বিরাট কোনো ভুল আছে বলেই আমার বিশ্বাস।
তো, ভুল যা-ই থাকুক, আমি ‘হোয়াট গৌজ এরাউন্ড কামস এরাউন্ডে’ বিশ্বাস করি। পৃথিবীজুড়ে একটা ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার শুভচক্র তৈরিতে বিশ্বাস করি। প্রতিদানের হিসাব না করে যদি আমরা প্রত্যেকে কারও না কারও পাশে দাঁড়াই, এবং এই চর্চা পৃথিবীজুড়ে চলতে থাকে, আমার দুঃসময়েও কেউ না কেউ পাশে দাঁড়াবেই। মৃত্যু-পরবর্তী স্বর্গ কামনা নয়, পৃথিবীটাকেই একটা স্বর্গের দেশ বানাতে আসুন অন্যের পাশে দাঁড়াই, যখন যেভাবে যেটুকু পারি। বাংলাদেশি ঈদ মোবারক।

জেসমিন চৌধুরী : কলাম লেখক ও অনুবাদক।
[email protected]

 
Electronic Paper