বিষয় : শাসক হাসপাতাল
সত্যজিৎ বিশ্বাস
🕐 ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২০
কী ভাবছেন, হাসপাতালের এ আবার কেমন নাম! নামখানা দেখে আমিও চমকে গিয়ে থমকে গিয়েছিলাম। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন না তো! একটু খোঁচাখুঁচি আর খোঁজাখুঁজি করে যা জানলাম, ধারণা পুরোপুরি ডিগবাজি খেয়ে গেল। নামের সঙ্গে কাজের এমন অপূর্ব মিলওয়ালা সোনার ডিম পাড়া হাঁস পাতাল, স্বর্গ, কিংবা মর্ত্যে গুগোল সার্চ দিয়ে কোথাও খুঁজে পেলাম না।
শাসক হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ইদানীং করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালটির নাকি লাইসেন্স নেই, টেস্ট না করেই রিপোর্ট প্রদান করে, চুক্তিভঙ্গ করে রোগীদের কাছ থেকে বিল আদায় করে, ভুল রিপোর্ট প্রদানসহ নাকি ১০৮টা অভিযোগ! অনেক ভেবে দেখলাম, ভালো কাজের আসলে কোনো মূল্য নেই। এই মহামারিকে অন্তরের অন্তঃস্থলে নিয়ে হাসপাতালটি যেভাবে কাউকে সংক্রমিত না করে ম্যাজিক পদ্ধতিতে কাজ করছিল, সেই ম্যাজিক দেখাতে বিশ্বের আর ক’টা দেশ পেরেছে শুনি? একটুও সময় অপচয় না করে হাজার হাজার রিপোর্ট প্রদান করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন নোবেল দাবি করবে কিনা ভাবছিল, সেই মূহূর্তেই ঘটল অঘটন। কোথা থেকে কোন উড়ো খবর পেয়ে উড়ে এল একঝাঁক কালো মেঘ। এখন কে কাকে বোঝাবে, এসব ষড়যন্ত্র, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি, এসব এডিট করা যায়!
টেলিভিশনে, দৈনিক পত্রিকায়, ফেসবুকে অহেতুক সমালোচনা দেখে সত্যি মন খারাপ হয়ে যায়। কেউ কারো ভালোটা সহ্য করতে পারে না। কেউ একটু এগিয়ে গেলেই হল। বাকিরা সবাই টেনে হিঁচড়ে নামাবে তাকে। একেই বলে কলিকাল। ঘোর কলিকাল। এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা অবশ্য এই কালকে কলিকাল বলে না। ওরা বলে অন্য কথা।
অনলাইন ক্লাসে একদিন।
শিক্ষক : বল তো, কাল কত প্রকার?
ছাত্র : স্যার, এক প্রকার।
শিক্ষক: এক প্রকার মানে? এটাও জানিস না, কাল তিন প্রকারÑ বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ।
ছাত্র : ওটা তো আপনাদের সময় ছিল। এখন একটাই কাল।
শিক্ষক : কী কাল শুনি?
ছাত্র : কেন, করোনাকাল।
এই করোনাকালে সবাই যখন করোনা টেস্ট করা নিয়ে ভিত-সন্ত্রস্ত তখন দেশের মানবসেবায় যে কয়েকটি হাসপাতাল ছুটে এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম এই শাসক হাসপাতাল। দুষ্টু লোকেরা বলে, ২০১৪ সালের পরে হাসপাতালটির নাকি আর লাইসেন্স নবায়নই করা হয়নি। কেন জানি মনে হয়, যারা বলেন, তারা লাইসেন্সের মানেই জানেন না। যারা জানেন তারা তো জানেনই আর যারা জানেন না, চলুন তাহলে লাইসেন্সের মানে জেনে নেওয়া যাক।
সাংবাদিক : কী ব্যাপার, রাস্তায় মুড়ির টিন মার্কা বাসগুলো একটা আরেকটাকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, ওগুলোকে আটকে লাইসেন্স চেক করছেন না যে?
পুলিশ সার্জেন্ট : ওদের সবার লাইসেন্স আছে।
সাংবাদিক : চেক না করেই কী করে বুঝলেন, লাইসেন্স আছে?
পুলিশ সার্জেন্ট : আরে ভাই, এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার। ‘লাই’ ‘সেন্স’ না থাকলে কী আর ঢাকা শহরে টিকতে পারে?
মিথ্যেটাকে গুছিয়ে বলার ক্ষমতা, এ জাদুর শহরে কার নেই? এরপরেও লাই-সেন্স নিয়ে সন্দেহ? তাহলে কটন বাড দিয়ে ভালো করে কান পরিষ্কার করে শুনুন, স্বাস্থ্য অধিদফতর হাসপাতালটিকে কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল বলে অনুমোদন দিয়েছে।
এবার আসা যাক টেস্টের ব্যাপারে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বাহ্বা না দিয়ে পারাই যায় না।
পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট! কখনো ভেবে দেখেছেন, কী অভিনব আবিষ্কার এটি! পরীক্ষা মানেই তো করোনা নিয়ে টানাটানি। মানুষকে শুধু শুধু ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। করোনা টেস্টিং কিট বাঁচিয়ে, সময় বাঁচিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার এমন পদ্ধতি এই গ্যালাক্সির অন্য কোথাও আছে? করোনার আগে তো নোবেল করোনা বলতে পারেন, কই এমন সার্ভিস দেওয়া হাসপাতালটির আগে নোবেল যোগ করতে এত দ্বিধা কেন? করোনা বিদেশি, আর হাসপাতালটি দেশি বলে? করোনার বেলায় নোবেল করোনা, আর আমাদের শাসক হাসপাতালের বেলায় ‘নো’ ‘বেল’!
কী বললেন, ‘হাসপাতালটির সঙ্গে সরকারের চুক্তি ছিল, ভর্তি রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবেন’ তো সেটা অস্বীকার করল কে, আর কথার বরখেলাপই বা করল কে? চুক্তি তো হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের হয়েছে। রোগীদের সঙ্গে তো হয়নি। রোগীরা বিল দেবে না কেন?
স্যাম্পল কালেক্টারগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে ভুল রিপোর্ট প্রদান করেছে বলে বলা হচ্ছে। এটা কেমন কথা হলো আপনারাই বলুন? ভুল রিপোর্ট প্রদান করা হচ্ছে কী করে বুঝলেন? যেখানে পরীক্ষাই করা হয়নি, সেখানে ভুল-শুদ্ধের কথা আসে কোথা থেকে? এ অন্যায়, এ ঘোরতর অন্যায়।
কী, আছে আর কোনো অভিযোগ? এবার তাহলে দুটো কথা বলি। কথা দুটো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেবেন, নাকি পকেটে ভরে রাখবেন সেটা আপনার মর্জি। শাসক হাসপাতালের মালিকের যে সেলফিগুলো দেখে আপনাদের বুক জ্বলছে, তা আক্ষেপে জ্বলছে। ওনার মতো করে সেলফি তোলার সুযোগ থাকলে আপনি কি বসে বসে এ লেখা পড়ে সময় নষ্ট করতেন? তিন মহারথি বসা যে ছবিটা দেখে আপনাদের বুক হু হু করছে সেটা হিংসায় করছে। ভাই রে, এভাবে কলম ধরে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হিম্মত লাগে। লাইসেন্স আপডেট থাকা ক’টা হাসপাতালের এমন হিম্মত আছে শুনি? এমন প্রতিভাধর হাসপাতাল কর্ণধারকে তো আমাদের মাথায় তুলে প্রতিভার মূল্য দেওয়া উচিত। আফসোস, এই প্রতিভা এতদিন যাদের কাছে মূল্যবান ছিল, সেই প্রতিভাধররা আজ অন্য কোন ট্যালেন্ট হান্টের খোঁজে ব্যস্ত।
শুধু প্রশ্ন দেখেই (উত্তর না দেখে) এই কুইজগুলোর সঠিক উত্তর যারা দিতে পারবেন, তারা নিশ্চিত আগামী দিনের প্রতিভাবান। করজোড়ে অনুরোধ রইল, পাঠক তাদের চিনে (চীন-এ) রাখুন।
বলুন তো দেখি, প্রথমবার স্কাই ডাইভিং করতে কী লাগে?
কী বললেন, জাম্পসুট, জুতা, ডাইভিং সুট, টুপি, সানগ্লাস, প্যারাসুট আরও কত্ত কী লাগে? আরে ধুর, এসব কিচ্ছু লাগে না, শুধু ঝাঁপিয়ে পড়লেই হয়। এসব লাগে তো দ্বিতীয়বার ডাইভিং করার ইচ্ছা থাকলে।
এবার বলুন তো দেখি, বিয়ে করার সময় কী লাগে?
বাড়ি, গাড়ি, টাকার কথা ভাবছেন তো? আরে ভাই, এসব কিচ্ছু লাগে না। ফরমেট আগেরটাই। ঝাঁপিয়ে পড়লেই হয়। শুধু সাহস থাকলেই হল।
আচ্ছা এবার বলুন তো দেখি, একটা হাসপাতাল দিতে কী লাগে?
এখনও ভাবছেন? আরে ভাই ফরমেট তো সেই একটাই। ঝাঁপিয়ে পড়লেই হয়। শুধু সঠিক সময়ে সঠিক সেলফি তুলতে জানার কৌশলটা জানলেই হল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : এখানে লেখা সব প্লট এবং চরিত্র লেখকের চক্ষু মুদিত নাসিকা গর্জনের অর্জন। নাক ডেকে ঘুমিয়ে পাওয়া চরিত্ররা যে কাল্পনিক চরিত্র হবে, তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। ভিনগ্রহবাসী ছাড়া কেউ যদি মিল খুঁজে পান, সে দায় তার!
সত্যজিৎ বিশ্বাস : রম্য লেখক