ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বই পড়লে দৃষ্টি মেলে

ইমরুল কায়েস
🕐 ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৯, ২০২০

পৃথিবীর অতি সুন্দরতম জিনিস হল ফুল আর কলঙ্ক ছাড়া মন বা পাপ বিযুক্ত মানব মন অথবা আরো বিস্তৃত অর্থে হিংসাবিহীন চিত্ত। দ্বিতীয় সুন্দর জিনিসটির উদারহণ হল সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মন। একটি বই যেমন করে পৃথিবীর ঝরে যাওয়া সব ফুলের সুবাস পাতার মধ্যে নেয় তেমনি কোনো ব্যক্তি যখন নতুন একটি বই হাতে নেয় তখন ঐ বইয়ের মলাটবদ্ধ অজানা জগতের সামনে একটি শিশুর মন নিয়েই বসে।

কেননা সেই জগৎটি তার কাছে নতুন এবং জানার আনন্দে পুলকিত হয়। এরকম জানা অজানা সকল অপূর্ব সুন্দরের আখর হল বই। চর্ম চক্ষু অন্ধকারে নিপতিত থাকে। মানবের বাহ্যিক ও অন্তর চক্ষুকে তীক্ষ্ণও দূরকে দেখার জন্যে ভেদনশীল করে বই। অন্তর মম দৃষ্টিকে নিকাশ করে বিকশিত করে বই। মনীষীরা বলেন বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। এ অতি পুরনো কথা। বই কিনে, পড়লে; মানুষ মানে ও মনে বড় হয় এটাই শাশ্বাত সত্য। সৃষ্টিতে, সৌন্দর্যে বই তুলনায় অতুলনীয়।

বইবিহীন জীবন, দৃষ্টি ছাড়া সৃষ্টি আন্দাজ করার মতো। এতে না মেটে সুন্দর সৃষ্টিকে দর্শনের তৃষ্ণা; না মেলে নতুনকে পাওয়া। বইয়ের একটি অতি আশ্চর্য রকমের ক্ষমতা আছে যা অন্য কোন বস্তুতে নেই ফুল আর বই সবাই হাত বাড়িয়ে ধরে দেখতে চায়। কেউ দূরে থেকে ফুলের ঘ্রাণে তুষ্ট হয়ে হৃষ্ট চিত্তে ফিরে যায়। আবার কেউ কেউ গাছের ডাল ধরে ফুলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে সুবাস ও দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য দেখে নতুন ফুলের আশায় গাছের যত্ন নেয়।

যে দ্বিতীয় কাজটি করল সে একই সঙ্গে দৃষ্টি ও সৃষ্টি দুটোর স্বাদ নিবৃত্ত করতে পারল। এজন্য দেখার চোখকে আতশী করে তুলতে একধরনের পরশ পাথরের ছোঁয়া লাগে। কাচ কি এমনি এমনি আতশী হয়! তেমনি সাধারণ একটি মানব চোখকে অসাধারণ দৃষ্টির ও সৃষ্টির অনাবিল সব অদেখা সৌন্দর্যকে অবলোকন করাতে চাই বই পড়া। বই পড়া হল পরশপাথর; যার ফলে চোখ হবে আতশী।

মনের যোগ সাধনার মন্দির হল বই। মনের দ্বার খোলার জন্য এই মন্দিরে প্রার্থনা করতে হবে। কেননা সকল অশুভকে দূর করার মায়ামন্ত্র আছে বইয়ে। এক পাতা থেকে দুই, তিন এমন দিন দিন চলবে নতুনকে ভাঙিয়ে আরেক নব-নতুন সৃষ্টি করে অনাগত নবীনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যম বই। পৃথিবীর যত কুৎসিত জিনিস আছে তা দূরীভূত করার জাদুর বিন। সত্যিই বই একটি জাদুর বিন। যিনি কখনোই পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য বই পড়েননি তিনি যদি কোনোভাবেই এই করোনা বন্দিজীবনে একটি বই পড়ে শেষ করতে পারেন অবশ্যই হাতের অনতিদূরে নতুন আর একটি বই পড়ার জন্যে খুঁজবেন। বইয়ের সঙ্গে মিতালি মানে দুনিয়ার সমগ্র মোহনার সঙ্গে আপনার দেখা হবে। আর তখন দেখতে পাবেন এক মোহনায় কত রকমের জলের ধারা বইছে। দেখার মতো কত রঙয়ের জলের ধারা আসছে আর যাচ্ছে!

ধর্মীয় প্রার্থনা আর বই পড়া এই দুই কাজে কোনো মানুষ কখনো কাউকে বিরক্ত করে না। দুটোই নীরব প্রার্থনা। আর পৃথিবীর সমস্ত বইয়ের আদর্শ কালি বা অক্ষর কালো কালিতে লেখা। কালো সব সময় জগতের ভালো। কালো রঙ রাতের আলোতে যেমন সাদাকে ধরে; তেমনি দিনের আলোতে সাদাকে ধরতে পারে। ফলে মানুষের চোখের ক্ষতি হয় না। মনোযোগ বাড়ে। দুই মলাটের ভেতরে আশ্চর্য সব ঘটনার পরম্পরা সাজানো থাকে একেকটি বইয়ে। একেকটা পাতা উল্টালে একেকটি অজানা জগতের অসীম দুনিয়ার দ্বার উন্মোচিত হয় পাঠকের সামনে। পাঠক নিমগ্ন চিত্তে হারিয়ে যায় সেই জগতের অজানা সব অলিগলিতে এক ভালোলাগার মায়াবী আবেশে। এ যেন পাতায় পাতায় কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের স্বাদ!

ইসলামে বলা আছে নিজের জিহবা এবং গোপন স্থানের হেফাজত করতে। এই দুই স্থানের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। পাপের হিসাব এই দুই জায়গার আগে নেবে। জিহবা বলতে এখানে কথা বলা ও খাবার গ্রহণকে বোঝানো হয়েছে। কথা যত কম বলা যাবে তত পাপ ও বিশৃঙ্খলা কম জন্ম নেবে। আর এগুলো থেকে দূরে থাকার মোক্ষম দাওয়াই বই। প্রবাদ আছে নির্বাক বা বোবার কোনো শত্রু নাই। নির্বাক বলতে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ; ধ্যানমগ্ন মানুষ।

বই পড়ুয়া মানুষ ধ্যান মগ্ন থাকেন বা থাকতে ভালোবাসেন। তাই শত্রুর চেয়ে বন্ধু বেশি জন্মে। কেননা বই পড়লে মানুষ যেমন নিজের ত্রুটিগুলোকে ধরতে পারে। শুধরে নেয় তেমনি অপরাপর মানুষকে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে শেখে। ফলে মিছে তর্কে জড়ায় না। পরনিন্দা, পরচর্চা করার সময় বইপড়ুয়া মানুষের হাতে থাকে না। একজন মানুষের অধিকাংশ শত্রু সৃষ্টি হয় হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও পরচর্চায়। মানুষকে এই বিষয়গুলো থেকে দূরে রাখে বই। বই মনের বর্জ্য দূর করে মনকে প্রস্ফুটিত করে মোহনীয় পুষ্পে। সেই পুষ্পের সৌরভে জীবন ও জগৎ হয়ে উঠে মনোহর। তাই বইয়ের বিকল্প বই ছাড়া দ্বিতীয়টি আর এই বিশ^ চরাচরে আছে বলে এখন পর্যন্ত কোনো দার্শনিক বা আবিষ্কারক উদ্ভাবন করতে পারেনি।

সমাজে প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ খুবই দরকার। এজন্য প্রয়োজন বই পড়ার, বইয়ের সাহচর্য। বইয়ের নিমগ্ন পাঠক। প্রকৃত জ্ঞানী হওয়ার জন্যে জ্ঞানের পরপর তিনটি স্তরকে অতিক্রম করতে হয়। আপনি যখন কেবল প্রথম ও প্রান্তিক স্তরে থাকবেন তখন নিজেকে বড় পণ্ডিত ও অহংকারী মনে হবে সব জানেন! যখন ক্রমে ক্রমে বই পড়া আর অধ্যবসায় বাড়িয়ে দেবেন তখন প্রথম স্তরের ভুলগুলো বুঝতে পারবেন একটু বিনয়ী হবেন। সর্বশেষ স্তরে পা রাখলে আপনি পেছনের জানাগুলোকে নাই করে দিয়ে বুঝতে শিখবেন আদৌ এই জগতের কিছুই জানেন না। তখন আপনাআপনি বিনয়ে বিনীত হবেন।

সৃষ্টির কাছে আপনার মস্তক নত হবে। এই ধাপগুলো হল বই পড়া, চর্চা করা। এ প্রসঙ্গে সক্রেটিসের কথা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না, সে কিছুই জানে না। আর আমি একটা জ্ঞান লাভ করেছি, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কিছুই জানি না। প্রকৃতপক্ষে বিশাল এই জগতে রহস্যের ও জানার শেষ নেই। অজানা সব বিষয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে জানতে হলে প্রচুর বই পড়তে হবে এর বিকল্প নেই।

বইবিহীন একটি ঘর বা বাড়ি জেলখানার চেয়েও নিকৃষ্ট। মানুষের মধ্যে বোধি চিন্তা জাগ্রত করার তীর্থ পীঠÑ বই। বইকে ভালোবাসলে এই জগতকে জানা যায়; সৃষ্টির প্রতি প্রেম জন্মে। কারণ জগতের সব রহস্য বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকে। যেমনÑ পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ। এই গ্রন্থসমূহ যতই পাঠ করবেন ততই পাঠের অভিনিবেশে সৃষ্টির অভেদ্য ও অজ্ঞাত রহস্যের একেকটি দ্বার টপকিয়ে আরও মহত্তর গূঢ় রহস্যের দিকে ধাবিত হবেন। যত পড়বেন ততই আপনার জ্ঞেয় দৃষ্টি শক্তির বাইরে ঘটমান আলাদা জগতকে দেখতে পাবেন। বই এই দুয়ার মেলে ধরার একমাত্র ও প্রধান বাহন।

এতে কোনো সন্দেহ নাই। করোনাকালীন বন্দিজীবনে বা অবসরে পড়ে ফেলুন না নিজ ধর্মগ্রন্থের ওপর লেখা ভালো ভালো বই। শেলফে যাদের বই সাজিয়ে রাখা আছে হয়ত ব্যস্ততার কারণে আর ধরে দেখা হয়নি কিংবা গেল বইমেলায় বন্ধুর চাপে, বসের সদয় পেতে বা প্রেমিকার সামনে লেখক-কবি সাজতে যে নিয়তে বই সদাই করেছিলেন কিন্তু আর খুলে দেখেননি। ধুলো ঝেড়ে নিন হাতে একটা বই; দেখবেন করোনাভীতি কমে যাবে, অবসরটা উপভোগ্য হবে।

ভূ-পৃষ্ঠের অধিক চাপে খনিজ যেমন হীরে হয়ে দ্যুতি ছড়ায়; তরল আকরিক অধিক তাপে কঠিন লোহা হয় আবার শক্ত লোহা অধিক চাপে চ্যাপ্টা হয়ে জাহাজ হয়ে পানিতে ভাসে তেমন প্রতিটি দুঃসময়ের সঙ্গে কিছু সুসময় মানুষের জীবনে আসে। করোনা মহামারি নিঃসন্দেহে একটি চরম ভোগান্তির সময়। কিন্তু সময়টি আমাদের হাতে এনে দিয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর বিস্তৃত কর্মহীন ঘরবন্দি জীবন; বিশেষ করে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকদের হাতে অবারিত সময়।

এমন চারমাসের অবসরে ঘরে মুঠোফোনের রঙিন পর্দায় চোখ ব্যথা না করা পর্যন্ত টক্কে টক্কে না থেকে নিজের সুপ্ত মেধাকে বই পড়ে শাণিত করা জরুরি। এই দীর্ঘ সময়ে নিজের মনের খেয়ালের বা পছন্দের সব বই পড়ে ফেলা যায় অনায়াসে। ঘরবন্দি মনের অবসাদ ও করোনা ভয়কে দূর করার জন্য বই পড়া সবচেয়ে বড় থেরাপি। একটু চেষ্টা করলেই করোনা দুঃসময়কে বই পড়ে নিজেদের জন্য একটি সুসময় করে নিতে পারি।

করোনা অবকাশে বইয়ের পাঠক সৃষ্টি হওয়ার একটি যুতসই সময় যাচ্ছে। এ সময়ে যেন বসে থেকে শিক্ষার্থীরা মেধাকে ভোঁতা না করে ফেলে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবাই এ রকম মোক্ষম সময় আর পাবে না। পড়ে ফেলুন হাতের কাছে যা আছে তাই। সকল অনাকাক্সিক্ষত ঝুট জঞ্জালকে এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে বসে পড়–ন বই নিয়ে। করোনা ভয় জানালা দিয়ে পালিয়ে আপনার ভেতরে বিশ্বজয়ের শিহরণ জাগিয়ে দেবে বই। নিজের সেরাটা বের করে আনার সময় এখনই। এখন সুবর্ণ সময় নিজেকে ঝালিয়ে নিন। ইসলামে আছে জ্ঞানচর্চা বা বই পড়া অবস্থায় কেউ মারা গেলে তার হিসাব হবে না। আরো আছে একজন জ্ঞানীর ঘুম সীমান্তে রাত জেগে পাহারা দেওয়া প্রহরীর জেগে থাকার চেয়ে শ্রেয়।

পড়ে ফেলতে পারেন নিজের দেশটাকে জানার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বই। দেশটাকে স্বাধীন করা ও গড়ার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, আজীবন সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তাদের জীবনী। যিনি আমাদের স্বাধীন দেশের জল হাওয়া সেবন করার সুযোগ এনে দিয়েছেন পড়ে ফেলতে পারেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু কীভাবে জেলে বন্দি থেকে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন; বই পড়েছেন নিজের আত্মজীবনী ও কারাগারের দিনসমূহ লিখে আমাদের বিখ্যাত দুটি বই উপহার দিয়েছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা। তিনি যেভাবে বন্দি জীবনে দমিয়ে যাননি তেমনি আমরা করোনাকালে বসে থাকব না। জেলে বন্দি থেকে বই পড়েছেন, লিখেছেন। আমরাও এমনটা করতে পারি।

বইয়ের পাতায় যত ডুব দেবেন ততই আপনার মেধা শাণিত হয়ে প্রখর ও চিন্তাশীল হবে। বই পড়লে নিজের মধ্যে ধৈর্যশক্তি সঞ্চিত হয়। বিপদের সময় ধৈর্য একটি বড় শক্তি। একজন মানুষের সবচেয়ে যেটি দরকার তা হল উইল পাওয়ার। এটির দেখা পাবেন বই পড়লে। এই শক্তিকে যিনি যত কাজে লাগাবেন তিনি তত কামিয়াব হবেন। বই পড়লে বন্দিজীবনের একঘেয়েমি থাকবে না। অস্বস্তিসমূহ দূর হয়ে মনে ও শরীরে স্বস্তি আসবে।

বই সাধারণ দৃষ্টিকে দূরদৃষ্টিতে পরিণত করে। আপনার মেধা যত শাণিত হবে চিন্তা তত প্রখর হবে। সঞ্চিত দূরদৃষ্টি আর প্রখর মেধায় হয়ে উঠবেন প্রাজ্ঞ মানুষ। তখন অতীন্দ্রিয়গুলো কাজ করা শুরু করবে। আর তখনই দৃষ্টি মেললে সৃষ্টিকে দেখতে পাবেন।

ইমরুল কায়েস : গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তা

[email protected]

 
Electronic Paper