মাদক নির্মূলে কঠোর হতে হবে
রেজাউল ইসলাম রেজা
🕐 ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৯, ২০২০
মাদক বর্তমান সমাজে ভয়াবহ ব্যাধি রূপে ধরা দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে দিন দিন। কচুরিপানার মতোই সারা দেশ মাদকদ্রব্যের ওপর ভাসছে। গ্রাম থেকে শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই তা তরুণ সমাজকে গ্রাস করছে। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে বহু তরুণের জীবন বিনষ্ট হচ্ছে। ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজব্যবস্থায় রীতিনীতি, স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘিœত হচ্ছে। মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংসের পথে যুবসমাজ।
ভয়াবহ পরিণতি দেখে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বিচলিত। অভিভাবকরা আতঙ্কিত। ইসলামি শরিয়তের মতে, যে বস্তু সেবনের ফলে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পায়, তাকেই মাদকদ্রব্য বলে। ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইসলামী দ-বিধি’ গ্রন্থে মাদকের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে ‘যে সকল বস্তু মাদকাসক্তি সৃষ্টি করে, এবং যা সেবনে বোধশক্তি হ্রাস পায়, এদের সকল শ্রেণিই মাদকদ্রব্য।‘ মাদক একধরনের ভেষজ দ্রব্য, যা সেবনে মস্তিষ্ক ও শরীরের সংবেদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সুস্থ বিবেক ধ্বংস হয়। অতিমাত্রায় গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ স্তিমিত হয়ে যায়। ইসলামে সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য হারাম ঘোষিত হয়েছে।
মাদক সেবনের ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এর ফলে অকালে ঝরে যায় তাজা প্রাণ। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মানসিক ক্ষতি যেমন উচ্ছৃঙ্খল ও অসংলগ্ন আচরণ, উদাসীনতা, খিটখিটে মেজাজ, কর্মদক্ষতার অবনতি, অনিদ্রা, কাজে নিরুৎসাহ, উদাসীনতা, হতাশা, অবষাদ, বিষন্নতা দেখা যায়। এর ফলে সমাজে নানান রকম অপরাধমূলক কাজ চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, খুন, ধর্ষণের মতো কর্মকা- বেড়ে যায়। ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। মাদক আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়। ফলস্বরূপ পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। মাদকের ভয়াবহ বিস্তার উদ্বেগজনক।
অশুভ ছায়া ইতোমধ্যেই এশিয়ার দেশে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বাইরের দেশগুলোতে মদ জাতীয় দ্রব্যের খোলামেলা বিক্রি থাকলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা সম্পূর্ণ নিষেধ। তবুও তরুণরা এখন ভয়াবহ মাদকাসক্তির শিকার। কীভাবে মাদক হাতের নাগালে আসে, মাদকের ভয়ানক ছোবলে আক্রান্ত হয়, তা ভাবলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। সমাজে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, পারিবারিক অসচেতনতা, বেকারত্ব ও হতাশা, মাদকের সহজলভ্যতা, মাদকাসক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে বিচ্ছেদের কারণেও তারা মাদকের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দিন দিন। শহুরে জীবনে খেলাধুলা, চিত্তবিনোদনের অভাব থাকায় তরুণ সমাজ কৌতূহল বশবর্তী হয়ে মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীরাও মাদকের দিকে পা বাড়াচ্ছে। বন্ধুদের প্ররোচনায় পরে তারা এই অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। ধূমপান করা বেশিরভাগ তরুণদের কাছে এখন স্মার্টনেস হিসেবে গণ্য হয়। ফলস্বরূপ সিনিয়রদের দেখাদেখি জুনিয়রাও এই ভয়ানক পথে পা বাড়ায়। মাদক কেনার অর্থের জন্য পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। পরিবার থেকে অর্থের সংকুলান না হলে, একপর্যায়ে নানাবিধ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহজেই জড়িয়ে পরে তারা। বাংলাদেশে কী পরিমাণ তরুণ মাদক সেবন করছে তার পরিসংখ্যান বলা কষ্টকর।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশে এসব দেখে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। মাদক চোরাচালান করে সহজেই অধিক আয় করা সম্ভব। কম সময়ে অধিক মুনাফার লোভ, অল্প পরিশ্রম, রাজনৈতিক মদদদাতার সহযোগিতা ইত্যাদি আকৃষ্ট করছে তাদের। তাই সহজেই বেকার যুবসমাজ এসব অনৈতিক কাজে সংযুক্ত হচ্ছে। আর এদের সংস্পর্শে এসে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এ সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নেশার ছোবলে সামাজিক মেরুদ- ভেঙে পড়ছে। দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন শহরে, শহর থেকে গ্রামে। ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ জীবন। অকালে মৃত্যুর কোলে পতিত হচ্ছে তাজা প্রাণ।
তরুণ, যুবসমাজ দেশের প্রাণশক্তি। এরাই ভবিষ্যৎ চালিকাশক্তি। তরুণরা সমাজ গঠনের স্তম্ভ। সুন্দর, সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে তরুণদের ভূমিকা অতুলনীয়। দেশের উন্নয়নে এরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি আন্দোলন, সফলতার পেছনে রয়েছে তরুণদের অবদান। তরুণদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে নস্যাৎ হয়েছে হাজারও অনৈতিক কর্মকা-। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে ভারত বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসেমও তরুণ অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে পা রাখেন। করোনা মহামারির এই সময়টায়ও ভয়-ভীতি পাশ কাটিয়ে, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে আসছে তরুণরা। দরিদ্র, অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে। নিজেদের অর্থ ব্যয় করে বন্যার্ত মানুষদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তারা।
জাতির প্রাণের স্পন্দন এই তরুণ সমাজকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মাদকের ভয়ানক থাবা থেকে রক্ষা করতে হবে। মাদকদ্রব্যের হাত থেকে এদের রক্ষা করতে হলে আরও কঠোর হতে হবে। মেনে চলতে হবে সামাজিক অনুশাসন। পারিবারিক, সামাজিকভাবে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা আরও জোরদার করতে হবে। মাদকের কুফল সম্পর্কে সকলকে অবহিত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত খেলাধুলা, বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পরিবারকে আরও সচেতন হতে হবে।
সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাদক চোরাচালান রোধ, উৎপাদন বন্ধ, ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের কঠোর ভূমিকা গ্রহণ ও এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সবাইকে আইনের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রয়াস ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব, মাদকাসক্তির ভয়াবহতা থেকে জাতিকে মুক্ত করে আগামী উন্নয়নের পথকে আরও সুদৃঢ় ও বেগবান করা।
রেজাউল ইসলাম রেজা : ছাত্র, কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়