বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্য ও ভাড়াটিয়ার অসহায়ত্ব
নাজমুল হোসেন
🕐 ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৯, ২০২০
জীবন ও জীবিকার তাগিদে যে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম, চাকরি বা দেশসেরা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নের আশায় দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কয়েক দশক থেকেই। এসব মানুষ মাথা গোঁজার ঠাই নিতে ব্যবসা, চাকরি ও আয়-রোজগার বিবেচনায় যার যার শ্রেণি অনুযায়ী বাসা ভাড়া নেন। আর এই সুযোগে বাড়ির মালিকদের ভাড়ার নামে ভাড়াটিয়াদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানোর ঘটনা বহু পুরনো।
করোনা প্রাদুর্ভাবের এই সংকটকালেও ঢাকার বাড়িওয়ালারা যেন আগের চেয়ে দ্বিগুণ মাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। মানবিকের বদলে হয়ে উঠছেন রীতিমতো দানবিক। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের বহুদিনের। ইচ্ছামাফিক ভাড়া নেওয়া, হঠাৎ ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া, ভাড়া নিয়ে অনেক সময় রশিদ না দেওয়া; অশালীন আচরণ ইত্যাদি ঘটনা দীর্ঘদিনের। শুধু ঢাকায় নয়, কম-বেশি দেশের বড় শহরগুলোতেও বিষয়টা লক্ষণীয়। মূলত আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই বাড়িওয়ালাদের এমন অনিয়ম ও অত্যাচারের লাগামহীন সংস্কৃতি দিনের পর দিন পরিপক্ব হয়ে উঠেছে।
ঢাকা শহরে একটা বাড়ির মালিক হওয়া মানে পুরো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান বা জীবনের মূল্যবোধগুলোকে কিনে নেওয়া। সঙ্কটকালীন এই সময়ে সরকারের আইন, কঠোর নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে অনেক প্রভাবশালী বাড়িওয়ালাই ভাড়া না পাওয়ায় ভাড়াটিয়াদের বের করে দিচ্ছেন বিনা নোটিসে। মানছেন না কোনো আইন বা নিয়মনীতি। বাসা ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১’ থাকলেও সেটি না মানায় আজ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। অনেক বাড়ির মালিকও এই সম্পর্কে জানেন না। আবার কেউ কেউ জানলেও সেটি গ্রাহ্য করেন না। এই প্রবণতা রাজধানী ঢাকাতেই বেশি। মাথা গোঁজার ঠাই এবং বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার খাতিরে ভাড়াটিয়ারা মেনে নিচ্ছেন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা।
আইনের ১০ নম্বর ধারায় বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রিম এক মাসের ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও মালিকরা নিচ্ছেন কমপক্ষে তিন মাসের ভাড়া। এলাকাভেদে ছয় মাসের ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে। আইনের ১৬ নম্বর ধারায় বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধির নিয়ম না থাকলেও গত ২০ থেকে ২৫ বছরে ঢাকাতেই ভাড়া বেড়েছে ২০০ শতাংশ। এছাড়া ভবনে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ সংশ্লিষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের খরচ মালিকপক্ষের বহন করার কথা থাকলেও এটিও ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ায় অতিরিক্ত ৫ টাকা গুনতে হচ্ছে অসহায় ভাড়াটিয়াদের। ইদানীং লকডাউনের কারণে কাজকর্ম বা আয়-রোজগারের পথ বন্ধ থাকায় অনেক ভাড়াটিয়াই পারেননি বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে।
সম্প্রতি বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় কুষ্টিয়ার কমলাপুরে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করা, বিভিন্ন রকম হুমকি-ধামকিসহ অত্যাচার করে দুই মাসের সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীকে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রাতের বেলায় বাসা থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি। করোনা প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে এবার বিনা নোটিসে শিক্ষার্থীদের উৎখাত করছেন ঢাকার একশ্রেণির বাড়িওয়ালা। ধানমন্ডিতে শিক্ষার্থীদের সনদ, ল্যাপটপসহ সব জিনিসপত্র ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছেন এক প্রভাবশালী বাড়িওয়ালা। জানা গেছে, মার্চের মাঝামাঝিতে লকডাউনের কারণে ধানমন্ডির এক বাসায় সাবলেটে থাকা নয়জন শিক্ষার্থী যার যার বাড়িতে চলে যান।
সম্ভবত গত মাসের ২৫ তারিখে বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া চাইলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও বাসা ভাড়াসহ কয়েক হাজার টাকা দিয়ে অনুরোধ করেন বাকি টাকা দ্রুতই ঢাকায় এসে পরিশোধ করবেন। তার চারদিন পরে অর্থাৎ ২৯ তারিখ সজিব নামের কুমিল্লার এক ভাড়াটিয়া (ঢাকা কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শেষ বর্ষের ছাত্র) ঢাকায় এসে জানান তার গুরুত্বপূর্ণ সনদ, রুমমেটদের কারো এইচএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড, প্রবেশপত্র, বইপত্র, ল্যাপটপ, কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য বস্তু ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। খুঁজে পাননি কিছুই।
তাদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে দফায় দফায়। পরে বাসার দরজায় মালিক সাজিয়ে উচ্চ পদস্থ এক সামরিক কর্মকর্তার নাম ঠিকানা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। আরও জানা গেছে, প্রভাবশালী ঐ বাড়িওয়ালা তার নিকটাত্মীয় এক সামরিক কর্মকর্তার প্রভাব দেখিয়ে সজিব ও তার রুমমেটদের নানা রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন যাতে তারা কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেন। অন্যদিকে আরো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩০ জন শিক্ষার্থীদের একই ‘অপরাধে’ বিনা নোটিসে হোস্টেল থেকে বের করে তাদের জিনিসপত্রও গ্যারেজে স্তূপ করে রাখা হয়।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া নিয়মনীতি বহির্ভূত বা সরকার মহলের নির্দেশনাকে পাশ কাটানো বাড়িওয়ালাদের এসব অত্যাচার কবে থামবে? কবে হবে তাদের বোধোদয়? ছাত্র সমাজ ক্ষেপে গেলে বাড়িওয়ালাদের এমন প্রভাব হয়ত তাদের কাছে পাত্তাই পাবে না। দেশে শুধু শুধু সৃষ্টি হবে অশান্তি। বাড়ির মালিক হিসেবে ভাড়া না পেলে নিয়মমাফিক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে বাড়ির মালিকরা বোঝাপড়ার মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাই বলে ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস ফেলনা হিসেবে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার মতো অন্যায় অধিকার নিশ্চয়ই তাদের নেই!
তবে সব বাড়িওয়ালাই যে একেবারে নির্দয়, অমানবিক ও নিন্দনীয় আচরণ করেছেন তা কিন্তু নয়। এবারের করোনার এই কঠিন পরিস্থিতিতেও দেখা গেছে কতিপয় বাড়িওয়ালা মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখেছেন। তাদের কেউ কেউ নিজ ভাড়াটিয়াদের দুই-এক মাসের ভাড়া তো মওকুফ করেছেনই উল্টো আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যথাসাধ্য চাল, ডাল, তেল বা রান্না করা খাবার দিয়েও সহায়তা করেছেন। অবশ্য এই শ্রেণির বাড়িওয়ালার সংখ্যাটা নগণ্য অর্থাৎ সমুদ্রে মুক্তা খোঁজার মতোই। আসলে মানবিক ও মহানুভব সবাই হতে পারে না।
এটা সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক ও উন্নত মানসিকতার ব্যাপার। বড় শহরে বৈধ পথে বাড়িওয়ালা হয়েছেন খুব কম জনই। তাই এদের মন-মানসিকতা কতটা সংকীর্ণ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী বাড়িওয়ালাদের কঠোর এহেন আচরণে কিছু নির্দেশনার পাশাপাশি হুঁশিয়ার করেছেন। তবে এই হুঁশিয়ারিকেও প্রভাবশালী ও বিবেকহীন বাড়িওয়ালারা গায়ে মাখেননি। তাই সরকারের উচিত, ঢাকা শহরের এই নিয়ন্ত্রণহীন বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা। পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাছে অনুরোধ থাকবে, অন্তত ছাত্রদের ওপর হয়ে যাওয়া এমন অমানবিক ও অন্যায়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে যেন দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া বাড়িওয়ালাদের এসব অনিয়ম, অত্যাচার বন্ধে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১’ প্রয়োজনে সংশোধনপূর্বক দ্রুত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
নাজমুল হোসেন : প্রকৌশলী ও লেখক