মুদ্রা পাচার : অর্থনীতির কালো অধ্যায়
প্রণব রায়
🕐 ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৮, ২০২০
স্বাধীনতা অর্জনের পর নিজস্ব অর্থনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। অর্থনীতিকে সচল রাখতে বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ জুলাই। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে অর্থনীতি একটি মাঝারি মানের শক্ত কাঠামোতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই অর্থনীতির মূল চলক মুদ্রা নিজ দেশে এখনো অসংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানিতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।
কিন্তু জাতীয় স্বার্থের কাছে নিজ স্বার্থকে সমর্পণ করতে পারিনি। তাই তো আমাদের অর্জিত মুদ্রা বিনিয়োগ হয় বিদেশের মাটিতে। অসৎ উপার্জন পাচার হয়ে যায় বিদেশি ব্যাংকে। দেশের চেয়ে ব্যক্তি সচ্ছলতা যেখানে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় সেখানে মুদ্রার সুষম বণ্টন প্রত্যাশা করাই বৃথা। অসাধু ব্যক্তিদের এই মুদ্রা পাচার ক্রমে ক্রমে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। জাতীয় অর্থনীতি বারবার পড়ছে হুমকির মুখে। অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ এই ৪৯ বছরেও সোনার বাংলা হয়ে উঠতে পারেনি। এই না পারার মূল কারণ হল মুদ্রা পাচার। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ক্ষমতাসীন সরকারবান্ধব প্রায় সকলকেই এই পর্যন্ত মুদ্রা পাচারে ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারাও ভূমিকা রেখেছে মুদ্রা পাচারে। এতে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের অর্থনীতি।
মুদ্রা পাচার কী দেশ থেকে দেশের বাইরে অবৈধভাবে অর্থসম্পদ চলে যাওয়াই হলো মুদ্রা পাচার। আত্মসচেতন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কখনই মুদ্রা পাচারের মতো কর্মকা- সমর্থন করতে পারেন না। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশিত সোনার বাংলার অর্থনীতিকে বন্দি করে মুষ্টিমেয় অসাধু ক্ষমতাবান ব্যক্তি বিদেশে পাচার করছে কোটি কোটি টাকা। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট পাচার হয়েছে ৫৫৮৭.৭ কোটি মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সাড়ে তের হাজার কোটি টাকা।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য, বিদেশে অনুমোদিত বিনিয়োগের পরিমাণ চারশ’ কোটির কম। তাহলে বাকি টাকার উৎস কোথায়? থলের বিড়াল কি থলেতেই ঘুমোবে না বের হয়ে আসবে! এই বিপুল অর্থের পাচারকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে কখনই শক্ত অর্থনৈতিক ভিত সৃষ্টি হবে না। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মুদ্রা পাচারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এদেশে প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রা পাচার আজ ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে মুদ্রা পাচারে ২০১২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫১তম। কিন্তু পরের বছরই অর্থাৎ ২০১৩ সালে এই অবস্থান দাঁড়ায় ২৬তম।
২০১৩ সালে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার সমান। পাচার হওয়া এই অর্থ এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের তুলনায় ৩৩.৭৯ শতাংশ বেশি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক অর্থ জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রদেয় তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত মুদ্রার পরিমাণ ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে পাচারকৃত অর্থের কোনো তথ্য জিএফআই-কে দেওয়া হয়নি। জিএফআই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের দেড়গুণ। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০০১ থেকে ২০১০ সময়কালে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬০ কোটি মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫২ হাজার ৮ শত কোটি টাকা। ২০১০ সালে পাচার হয় ২১৯ কোটি ডলার যার পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকা। ২০১১ সালে ২৮০ কোটি ডলার এবং ২০১২ সালে ৭২২.৫ কোটি ডলার পাচার হয়।
যেসব কারণে মুদ্রা পাচার হয় তা পর্যালোচনা করলে যেসব তথ্য সামনে চলে আসে তা উল্লেখ করছি। সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণেই অর্থনীতির অনেক খাতেই ধস নেমেছে। যে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকা- প্রায় স্থবির, যেখানে বিনিয়োগ অত্যন্ত মন্থর, সেখানেই টাকাওয়ালাদের উদ্বৃত্ত অর্থ বিদেশে পাচার হয়। যেখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামোর অনুপস্থিতি বা অপ্রতুল ভৌত অবকাঠামো, সেখানে অর্থ পাচার হয়। পাচারকারীর মধ্যে রয়েছে চোরাচালানকারীরা এবং দেশে বিদেশে পুঁজি পাচারকারী ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক, শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও পুঁজি লুটেরা রাজনীতিবিদরা। এই পাচার হওয়া অর্থের বড় অংশ চলে যাচ্ছে সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে।
জিএফআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। যা দেশের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ টাকা পাচারকারী দেশের মধ্যে ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের স্থান। সংস্থাটির মতে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হওয়া এবং দুর্নীতি হচ্ছে টাকা পাচারের কারণ। দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমেছে। বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকাতে টাকা পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি ১২৫টি ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের সংগৃহীত তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে, ওই সব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকরা তাদের ব্যাংক ঋণের একটা বড়সড় অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হলমার্ক গ্রুপের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। বিসমিল্লাহ গ্রুপ ভুয়া কোম্পানি ও জাল দলিলের মাধ্যমে ১১০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর লাপাত্তা হয়ে যায়। এই টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়।
হলমার্ক গ্রুপও একইভাবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। কোনোভাবেই এই পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। এন্টি মানি লন্ডারিং আইন এবং দুদক, এনবিআর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা সত্ত্বেও মুদ্রা পাচার বেড়েই চলেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা মোট জিডিপির ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। মোট কথা রপ্তানি আয়ে বাংলাদেশের যা অর্জন, তার সঙ্গে তুলনা করলে বেশ বড় পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এখন অনেকে ইলেকট্রনিক পন্থা ব্যবহার করেও টাকা নিয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো মুদ্রা পাচার কেন হচ্ছে আর তা রোধই বা করা যাচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ নয় কেননা টাকা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির একটি সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দশ বছরে ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হয়েছে। কিছুটা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে জিডিপি সাড়ে ছয় শতাংশে থিতু রয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্ব ব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যআয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। আবার ২০২৪ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকেও বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে। এই গতিময় অর্থনীতিতেও মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে অধিক সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো নানা রকম সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে উপেক্ষা করে পুঁজির সঞ্চয়ন ও সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এসব অর্থসম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে থাকায় সুশাসনের অভাবে অনেকেই বিপুল পরিমাণ সম্পদ দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেন না। তারা তখন নানা উপায়ে ও কৌশলে অর্থ বিদেশে স্থানান্তর করে। আবার এক দেশের অর্থ অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার নানা ধরনের ব্যবস্থা বৈশ্বিকভাবেই রয়েছে। এরকম একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল স্থায়ীভাবে অন্য দেশের অভিবাসী হয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণ। অর্থ দিয়ে কোনো কোনো দেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে নাগরিকত্ব তথা পাসপোর্ট পাওয়া যায়। এসব দেশে কখনই জানতে চাওয়া হয় না টাকার উৎস কোথায়। এ পদ্ধতিতে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন।
পাচার হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। এই পাচারকৃত অর্থ দেশে বিনিয়োগ হলে বৈষম্য কমত। তাই মুদ্রা পাচার সুশাসনের মাধ্যমে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। দেশে বিনিয়োগের খাত সৃষ্টি করতে হবে। এতে সঞ্চয়নকৃত পুঁজি বিদেশে পাচার না হয়ে দেশেই বিনিয়োগ হবে। সুবিধাবঞ্চিত জনগণ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হবে। অর্থেরও সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে। অর্থনীতির কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটবে। আমাদের মুদ্রাও হবে সংরক্ষিত। বাংলাদেশ সত্যি সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
এই ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম। দুর্নীতি বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কোনো দুর্নীতিবাজ আমলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে হয়নি। তাই দিনে দিনে দুর্নীতির ভিত হয়েছে শক্ত। দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এই পাচারে অনুপ্রাণিত হচ্ছে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা। দেশের জন্য রাজনীতি করতে আসা রাজনৈতিক নেতারা প্রদর্শিত দেশপ্রেমকে পুঁজি করে হয়ে ওঠে পুঁজি লুটেরা। এই অবৈধ পথে আসা অর্থ গোপন করতে তা বিভিন্ন কৌশলে পাচার করে দেয় বিভিন্ন দেশে। ফলে সাধারণ শ্রমজীবীরা বঞ্চিতই থেকে যায়।
তাই সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত এখনই এই ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসা। কঠোর হাতে দমন করতে হবে মুদ্রা পাচার। তবেই অর্থনীতির এই কালো অধ্যায় ফিরে আসবে দিনের আলোতে। প্রত্যাশিত সোনার বাংলা হবে সমৃদ্ধ। বিশ্বের বুকে উন্নত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাঙালি।
প্রণব রায় : কলাম লেখক