ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্মরণ

মকবুলা মনজুর : বহুমাত্রিক কথাসাহিত্যিক

সাইফুজ্জামান
🕐 ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৮, ২০২০

মাথার ওপর থেকে চলে যাচ্ছে ছায়া এক এক করে। মহীরুহের মতো জ্বলজ্বল করতেন যারা তাদের প্রস্থান মন ভারাক্রান্ত করে। এ বছর যেন শুধু হারাবার, শুধু বেদনার! শুধু এমন রোদনভরা দিন এর আগে আসেনি। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে কিছু সুখরেনু মেখে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ করি। একে একে নিভছে দেউটি। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু শূন্যতা ও ক্ষত সৃষ্টি করছে। সাহিত্যের বিশেষ সংখ্যা সজ্জিত হতো যাদের লেখা, রেখা ও ভাবনায় তাদের অনেকেই আজ নেই। এর সঙ্গে শেষে যুক্ত হল মকবুলা মনজুরের নাম।

তার পরিচয় একাধিক ঔপন্যাসিক, গল্পকার, শিক্ষক ও নারী জাগরণের দূত। তার কথাসাহিত্য সমকাল ও মানুষের জীবন দ্বন্দ্বে মুখর। সমাজ রূপান্তর, ঘটনাপ্রবাহ ও নরনারীর যূথবদ্ধ জীবন তার কথাসাহিত্যের মৌল উপাদান। আধুনিক যুগকে তিনি যথাযথভাবে সাহিত্যে ধারণ করেছিলেন। জন্ম ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার মুগবেলা গ্রামে। পিতা মিজানুর রহমান। তার অনুজরা লেখক আজিজ মেহের, প্রাবন্ধিক ড. মোখলেসুর রহমান ও চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজান। এরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের বিখ্যাত মানুষ।

পারিবারিক অনুকূল পরিবেশ মকবুলা মনজুরকে লেখালেখিতে নিয়ে আসে। আট বছর বয়সে তিনি রচনা করেছিলেন একটি ছড়া। তিনি ছোটবেলায় মুকুল ফৌজের সদস্য ছিলেন। সঙ্গে বগুড়া এডওয়ার্ড ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে অভিনয় দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল। টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়াকালে তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। স্কুল থেকে বেরিয়ে মিছিলে অংশ নেন অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে। অংশগ্রহণকারী ছাত্রীদের স্কুলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। মকবুলা মনজুরকে ভারতেশ্বরী হোমসে ভর্তি করা হয়। সেখানকার বাধাধরা নিয়ম তার ভালো লাগেনি। কিছুদিন টাঙ্গাইলে মামার বাড়ি ও নিজের বাড়িতে সময় কাটান।

রুপালী ব্যাংকের অফিসার হিসেবে কাজ শুরু। লক্ষ্য, একাগ্রতা ও লেখালেখি তাকে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। হলিক্রস উচ্চ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মকবুলা মনজুর স্কুল প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি উইমেন্স কলেজ ও সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষকতা করেছেন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত থেকে নারীর অধিকার সচেতন করেছেন। অব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখেছেন যেমন তেমন রাজপথে সোচ্চার থেকেছেন। দৈনিক আজাদ ও বেগম পত্রিকায় তিনি ফিচার সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। বেগম পত্রিকায় ২৫ বছর যুক্ত ছিলেন।

মকবুলা মনজুর ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আইনজীবী মনজুর হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিস্তৃত লেখালেখি তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলে। মকবুলা মনজুর অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। উপন্যাসে অবদান রাখার জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭), জাতীয় আরকাইভস ও গ্রন্থাগারে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ (১৯৯৭), কমর মুশতারী পুরস্কার (১৯৯০), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ (১৯৮৪) অন্যতম। তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক পাননি। তার সাহিত্য ছিল উঁচু মানের। ধ্রুপদী ধারার সাহিত্য রচনায় পারদর্শী। জাতীয় পর্যায়ের এই দুটি পুরস্কার তাকে মরণোত্তর দেওয়া যায় কিনা ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। তার মতো একজন সাহিত্যিক এই ধরনের পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা সংরক্ষণ করেন। খুব নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। তার বড় পুরস্কার ছিল পাঠকের ভালোবাসা। একশ’ ভাগ তিনি পেয়েছিলেন।

মকবুলা মনজুরের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কালের মন্দিরা’। এই গ্রন্থে সমাজ ও সমকাল যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা ও সংগ্রাম নিয়ে তিনি অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিশোর উপন্যাস ‘ডানপিটে ছেলে’ চলচ্চিত্রায়ন করেছেন খান আতা। চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তার গল্প অনূদিত হয়েছে। মকবুলা মনজুর রচিত কিশোর উপন্যাস ‘মহেশখালীতে মুকুট’, ও ‘কিশোর মহাভারত’ বহুল পঠিত।

ঈদ কিংবা পূজো সংখ্যার জন্য একসময় পাঠক অপেক্ষা করত। আমরা শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে যাদের লেখাপড়ার জন্য উদ্গ্রীব থাকতাম তাদের মধ্যে মকবুলা মনজুর অন্যতম। আমাদের মানস গঠনে এই সব লেখকরা ছিলেন বাতিঘর। এদের চলে যাওয়া বড় ক্ষতি! বিচিত্রাসহ অন্যান্য সাপ্তাহিক কিংবা দৈনিক পত্রিকার বিভিন্ন আয়োজন আমাদের নৈতিক জাগরণ ঘটিয়েছে। বেগম মহিলাদের পত্রিকা হলেও আমরা ছিলাম নিয়মিত পাঠক। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো সওগাত। তার কন্যা নূরজাহান বেগম সম্পাদনা করতেন।

বেগম সুফিয়া কামাল, হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, দিলারা হাশেম, মকবুলা মনজুর প্রমুখকে আশ্রয় প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। বেগম পত্রিকার সর্বশেষ বাতিঘর মকবুলা মনজুর অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন গত ৩ জুলাই। তিনি স্নায়ুবিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন শেষ দিকে। মৃত্যু এক অমোঘ নিয়তি। জন্মিলে মরিতে হয়। হাহাকার, বেদনা ও অশ্রু সঙ্গী  হয়ে আছে কেবল। মকবুলা মনজুর ছিলেন সবার প্রিয় বকুল আপা। করোনাকালে আমাদের দিনযাপন বদলে যাচ্ছে। তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন বইমেলায় নিয়মিত আসতেন। তাকে ঘিরে আড্ডা জমে উঠত। একদিন নিশ্চয়ই ক্রান্তিকাল অতিক্রম হবে।

বইমেলা বসবে। অনেককেই আর আমরা পাব না। বকুল আপা থাকবেন আমাদের স্মৃতিতে, স্মরণে। আমাদের চেতনার উঠোনে তিনি দীপ্তি ছড়াবেন অনন্তকাল। নারীদের পরম আশ্রয়স্থল মকবুলা মনজুর। অনেক নারীর ব্যক্তিগত সমস্যা তিনি মিটিয়েছেন। সবাইকে স্বাবলম্বী হওয়ার বিকল্প নেই বলতেন। তিনি সাহিত্যে, সমাজ ভাবনায় অনুপ্রেরণা হয়ে জ্বলজ্বল করবেন। তার অগ্রন্থিত রচনা গ্রন্থাবদ্ধ হওয়া জরুরি। অনন্তলোকে শান্তিতে থাকুন প্রিয় মকবুলা মনজুর।

 

সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক

[email protected]

 
Electronic Paper