সম্পাদক বনাম লেখক রসায়ন!
নাসরীন রহমান
🕐 ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৫, ২০২০
এক সম্পাদক বন্ধুকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলাম, কেমন বন্ধু তুমি, তোমার পত্রিকায় আমার একখানা লেখা ছাপাইলা না! বন্ধু পাল্টা জবাবে বলেছিল, আগে লেখক হয়ে ওঠো, তখন দেখা যাবে! সেই থেকে লেখক হয়ে ওঠার চেষ্টারতই আছি, জানি না কবে ‘লেখক সমাজে’ আমার ঠাঁই হবে! মুদ্রার যেমন এপিঠ আছে তেমনি ওপিঠও; আমার মতো যারা দুর্ভাগা নয়, তারা হয়ত জানেন, বাংলাদেশে লেখক হয়ে ওঠা এখন বোধ করি তেমন কোনো কঠিন কাজ না! অন্তত হাল আমলের অনেক লেখকের ভাবসাব দেখে তাই মনে হয়!
এইসব ভুঁইফোড় লেখকের না আছে পা-িত্য না আছে কা-জ্ঞান! ভাবখানা এমন, লেখা দিলাম ছাপাইতে হইবই! কিন্তু সেই ‘লেখা’ যে আদৌ ‘লেখা’ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ কিনা তা ভাববার সময় কই তাদের! লেখক হয়ে ওঠার আগেই লেখক পরিচিতি চান এরা! লেখক হয়ে ওঠা কি এতই সহজ?
একজন লেখক হিসেবে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের পূর্বশর্তই হল, লেখক হয়ে ওঠার জন্য ব্যক্তির অদম্য আগ্রহ আর প্রবল স্পৃহা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে একাগ্রতা, যথেষ্ট জ্ঞান। লেখক তার সময়ের ছবি তুলে ধরেন লেখায়, লেখককে সকল ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা-চেতনাকে শাণিত করতে হয় কলমের মাধ্যমে। একজন লেখক তার লেখায় সময়কেই ধরে রাখেন না শুধু, ভবিষ্যতেরও ইংগিত দেন।
লেখক যখন লিখতে বসেন, তখন যদি তার নিজের সময়কে, সমকালকে মাথায় ধারণ করে না লিখতে পারেন, তাহলে তার সকল লেখালেখি আস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত একজন লেখকের জীবনে সম্পাদকের ভূমিকাও অপরিসীম। হীরের বাইরে থেকে ঔজ্জ্বল্য ধার নিতে হয় না, তবে সুপরিকল্পিতভাবে কাটিং করলে শুধু ঔজ্জ্বল্যই বাড়ে না, সঙ্গে বেড়ে ওঠে তার সৌন্দর্য, কদর। একজন সম্পাদক তেমনি জহুরির মতো নতুনদের তুলে নিয়ে আসেন, কেটে ছেঁটে তাকে লেখক হিসেবে সৃষ্টি করে নেন নিজের তাগিদেই! এটা লেখক গড়ার কারিগর হিসেবে তাগিদ; একজন সুযোগ্য সম্পাদকের হাতে পরে শুধু লেখকসত্তারই বিকাশ ঘটে না, দিনকে দিন হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ।
অভিজ্ঞ, সুযোগ্য সম্পাদকরা নবীনদের সমাজের সামনে, প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসার জন্য শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন, প্রকৃত প্রতিভাকে সুযোগ দিয়ে থাকেন। শ্রেষ্ঠ লেখা পাঠকে উপহার দেওয়ার জন্যই তারা নতুনদের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। একজন লেখকের জন্যে পুরো জীবনটাই একটা পাঠশালা, সেই পাঠশালার মাস্টার সম্পাদক নিজেই।
আজকাল অভিযোগ শোনা যায়; লেখা পাঠিয়ে লেখকের যেন তর সয় না! কবে ছাপা হবে লেখা এই তাগাদা দিতে থাকেন সম্পাদককে! লেখালেখি করতে এসে সংক্ষিপ্ত পথ খোঁজার অর্থই হচ্ছে ধান্দাবাজি। এই সংক্ষিপ্ত পথে যিনি হাঁটবেন তিনি আখেরে হারিয়েই যাবেন। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না; সম্পাদক তো নয়ই।
একজন পাঠক লেখা পাঠিয়ে দিয়েই খালাস! কিন্তু সম্পাদকের দায়িত্ব তখন বেড়ে যায় দ্বিগুণ; লেখাটি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য প্রয়োজনে পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা সবই করতে হয় সম্পাদনার টেবিলে। একজন সম্পাদকের কাছে তার নিজ পত্রিকা সন্তানতুল্য।
তাই সেক্ষেত্রে লেখকের ধৈর্য ধারণই উত্তম। লেখা উপযুক্ত হলে ছাপা হবেই, সম্পাদককে তাড়া দিয়ে লাভ নেই। আবার বিপরীতে, একজন সুযোগ্য সম্পাদক তার পত্রিকায় লেখার নীতিমালা প্রকাশ করে থাকেন; লেখকের উচিত, সেসব শর্ত ও নীতিমালা মেনে লেখা পাঠানো। সম্পাদকের পছন্দ না হলে ফেরত পাঠানো লেখা প্রয়োজনে সংশোধন করে দেওয়া। বানান, ব্যাকরণ, ছন্দ, অলঙ্কার সম্পর্কে লেখককেই সচেতন হতে হবে। এসব মেনে লেখালেখি করলে সম্পাদকের রূঢ় আচরণেও সম্পর্ক অটুট থাকবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এই, হাল আমলের অনেক উঠতি লেখকই সম্পাদকের টেবিল থেকে লেখা বাতিল হলে বা সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠালে সম্পাদকের নামে কুৎসা গাইতে পিছপা হয় না! এক লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠায়, যেখানে হোক ছাপা হলেই হবে, পত্রিকায় নিজের নামে লেখা ছাপা হলেই হল। এরা লেখক হতে চায় না, সস্তা নাম কামাতে চায়। আশপাশে লোক দেখানো লেখক পরিচিতি চায়; তাই তো লেখা পাঠিয়েই তর সয় না!
একসময় লেখক-সম্পাদকের মধ্যে ছিল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক; আজকাল এমনটা কমই দেখা যায়, যদিও ফেসবুকের কল্যাণে এখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন পাতার সম্পাদকদের সঙ্গে কারো কারো বেশ দহরম মহরম সম্পর্ক দেখা যায়। যা হোক, নতুনরা যারা লিখছেন তারা তো সবটাই আর খারাপ লেখেন না। সম্পাদক মহোদয়গণও তাদের উৎসাহিত করতে এডিট করে হলেও তাদের কিছু লেখা প্রকাশ করে থাকেন; বা সময় স্বল্পতার কারণে এত এডিট করার ঝামেলায় যান না, তো এমন যখন হয়, ‘পৃথিবীর সেরা লিখিয়ে’ যখন দেখেন তার লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়নি, তখন তিনি সম্পাদকদের এমনও সমালোচনা শুরু করেন, দেখে-শুনে মনে হয়, সম্পাদকের সম্পাদিত পাতা আর আগের মতো মানসম্পন্ন নয়। তার মানে, আগে ওই লেখকের লেখা ছাপা হত বলেই সেটা বেশ মানসম্পন্ন ছিল! এখন তার লেখা ছাপেন না বলেই সে পাতার গুণাগুণ কমে গেছে! ফেসবুকে এমন সব মন্তব্য দেখে-শুনে, গুরুবন্দনা যে এবার গুরুগঞ্জনার চক্করে, তাই মনে হয়!
এখানে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। এক ‘ফেসবুকীয় লিখিয়ে’ লেখা পাঠিয়েছেন তার পরিচিত সম্পাদকের কাছে। তো লেখা পাঠিয়ে তার আর তর সইছে না! সম্পাদক সাহেবকে মেসেজ করেছেন, ‘লেখা পাঠাইলাম, প্রাপ্তি স্বীকার করিয়েন। লেখা প্রকাশ হইলে মেসেজ বা ইনবক্সে লিংক দিয়েন’। মেসেজ পেয়ে সম্পাদক সাহেবের আক্কেলগুড়–ম! ‘প্রাপ্তি স্বীকার’ ‘লিংক দিয়েন’ তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে চরকিবাজির মতো!
তো এই যদি হয় লেখকের অবস্থা, কী করে সম্ভব লেখক হওয়া? লেখক হতে হলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, হুট করে লেখক হয়ে ওঠা সম্ভব না। বিশেষ করে সম্পাদকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পোষণ করতে হবে; যারা কলম ধরতেই শেখেনি তারাই দু’দিন যেতে না যেতেই সম্পাদকের সঙ্গে শুরু করেন বেয়াদবি, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পরিশেষে লেখাটি শেষ করতে চাই; যারা বিভিন্ন পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক আছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি নতুন অনেকেই লেখালেখির চেষ্টা করছেন, তাদের ভেতর সুপ্ত লেখক সত্তা আছে, তারা অনেকেই ভালো লিখছেন। সুযোগ পেলে এরাই একদিন নিজ প্রতিভায় বিকশিত হবে; এইসব তরুণ লেখকদের প্রকৃত মেধা বিকাশে সম্পাদকের ভূমিকা অনেক।
তাই শুধু প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পিছে পিছে ঘোরা নয়, আপনাদের উচিত নতুনদেরও উৎসাহিত করা, সুযোগ দেওয়া। কারো কোনো বড় পদ থাকলেই তার দাপট দেখানো উচিত নয়!
নাসরীন রহমান : কলাম লেখক