ড. আসিফ মাহমুদের কান্না ও স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ
সাঈদ চৌধুরী
🕐 ৭:২২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৫, ২০২০
অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন ড. আসিফ মাহমুদ। কেউ কেউ প্রচণ্ড রকম দ্বিধাহীনভাবে বলে গেছে বাংলাদেশ আবার আবিষ্কার করবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন! ট্রল করতে করতে আমরা এমন জায়গায় পৌঁছেছি যেখানে শুধু নিজেদের হীনম্মন্যভাবে প্রকাশ করতে শেখা ছাড়া যেন আর কিছুই নয়! দেশপ্রেমকে গিলে খেয়ে কিছু নেগেটিভ বিষয়কে বারবার সামনে এনে আমরা এমন এমনভাবে কথা বলছি যেখানে জাতিসত্তা কঠিনভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের মেধাবী একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট, যিনি গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে যখন বলেছেন আমরা আর কারও সুখী জীবন দুঃসহ জীবনে রূপান্তর হতে দিতে চাই না এবং তখনই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। গলায় কথা আটকে যাওয়া অবস্থায় আবেগ সংবরণের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা বলে দিচ্ছিল স্বজন হারানো মানুষের কান্নাগুলোতে মিশে আছে এমনই বুকচাপা কষ্ট!
আমরা প্রতিদিন যখন সংবাদ পড়ে পড়ে ক্লান্ত হচ্ছি- হাসপাতালের বেডে বাবাকে রেখে চলে গিয়েছে সন্তানরা, মাকে করোনা রোগী ভেবে জঙ্গলে ফেলে গেছে ছেলে, বাড়িওয়ালারা ডাক্তারের করোনা হবে বলে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছেন ঠিক এর বিপরীত পাশের কান্নাগুলো স¤পর্কে কতটা জানি?
এক ঘরে স্বামী করোনায় আক্রান্ত অন্যঘরে স্ত্রী আর ছোট্ট সন্তান থাকছে। স্বামীর প্রচণ্ড রকম শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বিছানায় থাকতে পারছে না, গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্লোরে আর চিৎকার করছে! পাশের ঘর থেকে স্ত্রী তার বাচ্চার কথা চিন্তা করে একবার আসতেও পারছে না! একসময় নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে দেহ। তারপর পরের দিন সরকারের মৃত্যুর খাতায় যোগ হচ্ছে তার নাম।
যে স্ত্রী বেঁচে আছে সে কি আদৌ বেঁচে আছে? চোখের সামনে দেখেছে স্বামীর বুকের ওপর পাহাড় সমান বোঝা চাপ দিচ্ছে আর একটু অক্সিজেনের জন্য নাসারন্ধ্র দিয়ে যখন নিঃশ্বাস টানার চেষ্টা করছে তখন যেন বুকের ওপর চাপ দেওয়া পাহড়ের বোঝা আরও বেশি করে চেপে ধরছে। একেবারে দিগি¦দিক হওয়া স্ত্রীর কাছে স্বামীর এমন চলে যাওয়া, মায়ের সামনে সন্তানের আকাশ বিদীর্ণ করা চিৎকার অথবা সন্তানের সামনে বাবা বা মায়ের প্রচ- বাঁচার আকুতি একবার অনুভব করে দেখেছেন? একটা কবিতা শুনেছিলাম। করোনার সময়ে লেখা।
কবিতাটির নাম শাড়ি। কবিতার মাঝখানে কবি বলছিলেন
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার হাসি বিস্তৃত হল
সামনের মাইক্রোফোনটা টেনে নিয়ে তিনি বললেন
আজ নতুন টেস্ট করা হয়েছে দশ হাজার
গত চব্বিশ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত সংখ্যা শূন্য
ভালো হয়ে গেছে শেষ রোগীটি
বাংলাদেশ আজ করোনা মুক্ত...!
এই কবিতার মতোই ড. আসিফের কান্না একটি বড় আক্ষেপের এবং পাশাপাশি স্বপ্নের জায়গা তৈরি করেছে। আক্ষেপের এ কারণে তিনি যখন বলছিলেন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে আমরা সক্ষম হচ্ছি ঠিক তখনই তার চোখের পানি বলে দিচ্ছিল আমরা হারানো মানুষগুলোকে আর ফিরে পাব না! কী কষ্ট করে শ্বাসের প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে মানুষগুলো আমাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছেন। কতজন ডাক্তার যারা শরীরের সব ভাষা বুঝে বুঝে তাদের মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হয়েছেন! কোনো কিছুই করা যায়নি প্রযুক্তির কল্যাণে, কোনো কিছুর বিনিময়ে বরং বরণ করতে হয়েছে অসহায়ের মতো মৃত্যুকে! আক্ষেপের জায়গাটিতে যখন নিজে দাঁড়িয়েছি তখন আমার চোখও ভিজে গিয়েছে বারবার।
আর আরেকটি ব্যাপার হল সফলতা। আজ ভ্যাকসিনের আবিষ্কারে যে সফলতা আমরা দেখছি তাতে আনন্দের কান্না থাকতেই পারে। সেখানে আমাদের দেশের মতো একটি দেশে থেকে এ পর্যায়ের গবেষণা আমাদের আনন্দের কারণ অবশ্যই! ভ্যাকসিনটি সফল হবে না ব্যর্থ হবে সে চিন্তার চেয়েও জরুরি হল আমাদের গবেষণার সক্ষমতা এবং ইচ্ছাশক্তির প্রবল প্রয়াস। ড. আসিফদের মতো, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো, বিজন কুমারের মতো যারাই নিজে থেকে তাদের কাজগুলো করে যাচ্ছেন এটাই আমাদের গর্বের জায়গা এবং আনন্দের জায়গা।
গ্লোব বায়োটেক আদৌ ভ্যাকসিনের সফল ক্রিয়াশীলতা দেখাতে পারবে কিনা সেটা যেমন সদূরপ্রসারী ব্যাপার তেমনি এ উপস্থাপনা এবং এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আমাদের শক্তি। গত কয়েকদিন ধরেই লিখে আসছিলাম বাজেটে গবেষণার কাজে আরও লগ্নি থাকুক। জাতীয় পর্যায়ে এমন গবেষণা আমরা দেখতে চাই। অনেক বৈজ্ঞানিক বাংলাদেশের হয়ে অন্য দেশে সফলতা দেখানোর পাশাপাশি দেশেও অনেক স্বপ্নের হাতছানি দেখাচ্ছেন। ডা. আসিফ গাজীপুরের শ্রীপুরের সন্তান, এটা গাজীপুরের গর্ব, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। আপনার কান্নায় সারা বাংলাদেশের স্বজনহারাদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। আপনার ও আপনাদের প্রয়াসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাশা করি দ্রুত যাতে এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে! অভিবাদন আপনাদের।
সাঈদ চৌধুরী : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি ও রসায়ানবিদ
শ্রীপুর, গাজীপুর