প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাবিহা খানম একা
🕐 ৮:০১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৪, ২০২০
সেই তো দিনটার কথা ১৭ মার্চ, ২০২০। পুরো ক্যাম্পাস আলোকসজ্জায় সজ্জিত। কেনই বা থাকবে না! দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ক্যাম্পাসের ৭০০ একর সেজেছে। সঙ্গে আছে ফিস্টের ব্যবস্থা। আগের দিন রাতে, হলে প্ল্যান করছিলাম কে কী রঙের শাড়ি পরব। ডিসিশন ফাইনাল, লাল রঙের শাড়ি পরছি কাল। আমি নিপুণকে বললাম, ফিস্টের কুপন কেটেছিস? খালারা নাকি এবার রুমে রুমে গিয়ে কুপন সরবরাহ করছে। শুনেছিস তোরা? নিপুণ ও আশা হতাশ মুখে বলে উঠল, ফিস্ট কি এবার খেতে পারব? আর আমাদের ভাঁজ না খোলা শাড়িগুলো পরে ভ্যানে করে গান গাইতে গাইতে হলগুলো দেখতে পারব? শুনলাম কী এক করোনাভাইরাস এ ছড়িয়ে পড়ছে।
বাসা থেকে আব্বু, আম্মু তাড়া দিচ্ছে দ্রুত বাসায় চলে যাওয়ার জন্য। আশা বলল, তুই আগেই কুপন কাটিস না, ফিস্ট খেলে একসঙ্গেই খাব আমরা। সেই একসঙ্গে খাওয়া আর হয়ে উঠল না। পরদিন সকালেই রওনা করল ওরা বাড়ির উদ্দেশে আর আমি দুপুর ৩টার বাসে।
ভাবিনি এতগুলো দিন অতিবাহিত করতে হবে! আসার সময় খুব মজাই লাগছিল! যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সপ্তাহে একটানা পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট দিয়ে যেন পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ৩১ মার্চ, ২০২০। রুটিনও হাতে পেয়েছিলাম। তাই তো সঙ্গে কিছু শিট, তিন চারটি পরার জামা আর ল্যাপটপটা নিয়ে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে আনন্দে বাড়িতে পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম এমন দিন আর ফিরে পাব না। নিজেকে সময় দেওয়ায় এটাই পারফেক্ট টাইমিং। প্রতিদিন রূপচর্চা করব। ক্যাম্পাসে ক্যান্টিনের ভাত, ডাল, মুরগি খেয়ে চেহারার যে অবস্থা বানিয়েছি এই কয়দিনের ছুটিতে তা ঠিক করে ফেলব। নেটফ্লিক্সে একাউন্টটা খুলেই নতুন সব মুভি দেখা যাবে।
হুমায়ূন আহমেদের কিছু না পড়া বই আছে। তাও পড়ে নেব, ক্যাম্পাসে থাকলে ইয়োগাটা কন্টিনিউ করা হয় না সেটাও করে ফেলব। ধীরে ধীরে সব হল। মুভি ফ্রিক হলাম, ঘরবন্দি থেকে গায়ের রঙ দুই শেড বেশি উজ্জ্বল হল, ইয়োগা করা রোজকার অভ্যাসে পরিণত হল। না পড়া বইগুলোও পড়া শেষ হল। কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাস, আর কত? ঘরবন্দি দশায় আজ কততম দিন সেটি ভাবলেই শিউরে ওঠে গা। চিনতে পারি না প্রাণবন্ত আমিকে! সেই ব্যস্ততম দিনগুলোই আবার ফিরে পেতে চাই। সকাল ৯টা ২৫ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস, লাঞ্চ ব্রেক, ক্লাসের ফাঁকে সেমিনারে বসা, টারজানের সেই চায়ের আড্ডা, বোরিং ক্লাসগুলো মিস দিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো, ক্যাফেটেরিয়ার আড্ডা, বিকেলের সেই গোধূলি দেখা!
আর তারপর প্রকৃতির সেই সুনসান নীরবতা, বৃষ্টিস্নাত রাত, সকালে পাখির কিচিরমিচির, পুরান কলার সেই হিজল ফুলের গাছ, এমএইচ-এর রাস্তা, টিএসসির ছাদ, চৌরঙ্গীর পুকুরপাড় সঙ্গে হালকা বাতাস, প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো বন্ধুদের গানের সুরে এবং আড্ডায়। ফিরে পেতে চাই সবুজ নগরকে। কথা দিলাম এবার আর অবহেলা নয়। বোরিং লেকচার শোনার ভয়ে হলে ঘুমিয়ে থাকা আমি আর একটি ক্লাসও মিস করবো না। তোমার নগরের প্রতিটি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে চাই। প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা উপভোগ করতে চাই, বোরিং লেকচারগুলো কান পেতে শুনতে চাই, হলে এন্ট্রি নেওয়ার সময় নিজ নামের জায়গায় সিনিয়র কোনো আপুর নাম লিখে বকুনি শুনতে চাই, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ লাউঞ্জের ট্যালটেলে সেই কফি খেতে চাই, মাঝে-মধ্যে জাদুঘর ঘর ভ্রমণের মতো লাইব্রেরি ঘুরতে না গিয়ে খুব করে লাইব্রেরিতে পড়তে চাই। শুধু একবার তুমি ফিরে এসো আমার সুদিন হয়ে। কথা দিচ্ছি, এবার আর কোনো লুকোচুরি নয়, নয় কোনো অলসতা। তোমার দেওয়া প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চাই, সবুজের সমারোহে আমি খালি পায়ে হাঁটতে চাই। হে আমার নগর, কথা দিলাম তোমায়!
সাবিহা খানম একা, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়