ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চীন-ভারত উত্তেজনা : যুদ্ধ নাকি কৌশল!

অরিত্র দাস
🕐 ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৪, ২০২০

ভারত ও চীনের মধ্যকার সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু সীমান্ত বিরোধ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আঞ্চলিক রাজনীতি বা ভূ-রাজনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ না হওয়া সত্ত্বেও চীন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার ইচ্ছা পোষণ করে আছে বহু বছর ধরে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য একমাত্র উত্তম হাতিয়ার। ভারতবর্ষ শাসন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা বাণিজ্যকে মূল হাতিয়ার করেই ঢুকেছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

তারপর দু’শত বছর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে শাসন করেছে। বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক কৌশল মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। বাণিজ্য দিয়ে পা ফেলে রাজনীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ চীন বাণিজিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় যতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, রাজনৈতিকভাবে ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এখনো। আর এটাই চীনের প্রবল বিতৃষ্ণা।

বস্তুত বর্তমান পৃথিবীতে অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব তাকিয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে, কখন কি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায় এখানে। তাই একবার দক্ষিণ এশিয়া হাতের মুঠোয় চলে এলে, এশিয়া মহাদেশ অতঃপর বিশ্ব শাসন করতে চীনের জন্য অনেকাংশে সহজ হয়ে যাবে। যার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় কমিউনিস্ট পার্টির বহিষ্কৃত বিপ্লবী নেতার যোগ্য ছেলে ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মুখে। তার একটাই কথা, চীনকে অবশ্যই পৃথিবীর ‘প্রাপ্য জায়গা’ নিশ্চিত করতে হবে। এই জায়গা নিশ্চিত করতে গিয়ে ‘শত্রুর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে’ যেতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না চীন।

ব্যর্থ বাবা শি ঝংজুন না পারলেও ছেলে শি জিনপিং কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতার স্বীকৃতি পেয়েছে। এর আগে এ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কেবল তিন জন। আধুনিক চীনের স্থপতি ও দলের সাবেক চেয়ারম্যান মাও সেতুং, আরেক সাবেক চেয়ারম্যান দেং জিয়াওপিং ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন পেয়েছেন। ২০১২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন শি জিনপিং। তার রাজনৈতিক স্লোগান ঠিক করেছে ‘চাইনিজ ড্রিম’। শি এই স্লোগানকে ‘চীনা জাতির নব মহাউত্থান’ হিসেবেই উল্লেখ করে সম্প্রতি বলেন, ‘এই নব মহাউত্থান লক্ষ্যে যুদ্ধ করতেও সে প্রস্তুত।’

যদিও কথাটি জাতীয়তাবাদের তীব্র আস্ফালন তবু তার এমন কথা থেকে একটা আভাস পাওয়া যায় যে, চীন তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে কতটা মরিয়া। এজন্য কি একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শি জিনপিং? সংবিধান পরিবর্তন করে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকার পথ সুগম করেছে। অথচ ১৯৮২ সালে জিয়াওপিং একনায়কতন্ত্রের ছোবল থেকে দেশকে বাঁচাতে নিয়ম করেন, একজন দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। ২০১৮ সালে সেই নিয়ম বদলে যায়। চলে আসে একনায়কতন্ত্র। চীনের সংসদ কর্তৃক শি’কে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হলে ভোটের মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব পাস করা হয়, একজন প্রেসিডেন্টের দু’ বার নয়, বরং বহুবার নির্বাচিত হতে পারবে।

নিজ দেশের সংবিধান না হয় পরিবর্তন করা গেল কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বেলায়? এখানে একমাত্র বাধা ভারত। দীর্ঘকাল ধরে এখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে দেশটি। তাই ভারতকে কোণঠাসা করতে চীন কৌশলগত পথ অবলম্বন করছে। অন্যদিকে ভারতও চায় দক্ষিণ এশিয়ার বড় ভাই হয়ে আজীবন থাকতে।

ক্ষমতা ও উচ্চ আসনের লোভ বড় লোভ, কেউ ছাড়তে চায় না। কিন্তু যে নক্ষত্র আজ আকাশের বিশাল জায়গা জুড়ে আছে, তাকেও একদিন ঝরে যেত হয়। বড় ভাইয়ের জায়গা এখন অনেকটাই নড়বড়ে। বর্তমান রক্ষণশীল সরকার ভারতের অভ্যন্তরীণ তালমাতাল ও বৈপরীত্য রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান গোছাতে গিয়ে আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে। ফলে সেই সুযোগটিই লুফে নিয়ে কাজে লাগাচ্ছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য দিয়ে শুরু করে চীন এখন কৌশলগতভাবে সামরিক ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

ভারত এবং চীনের সীমান্ত উত্তেজনা বা সংঘর্ষ বা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ভূ-রাজনীতির অংশ ও কৌশল হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে। রাজনৈতিক কৌশল এবং যুদ্ধ এক নয়। দুইটা দুই রকম; একটা উত্তর মেরু, অন্যটা দক্ষিণ মেরু। তাই যুদ্ধ নয়, রাজনৈতিক কৌশলকে হাতিয়ার করে দুই দেশই এই সীমান্ত সংঘর্ষ ও তাদের মধ্যকার উত্তেজনা বজায় রাখবে। নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য প্রদর্শন করবে। চীন যুদ্ধে যাবে না। কারণ দুইটি এক. চীনের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মার্কেট জনবহুল ভারতে, মহামারির কবলে পড়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চীন কোনোভাবেই অর্থনীতির মার্কেট হারাতে চাইবে না। দুই. চীনের শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। আন্তর্জাতিকভাবে চীনের সেই অর্থে কোনো বন্ধু দেশ নেই। তাদের একটি বন্ধু দেশ পাকিস্তান। রাশিয়া চীনের নব্য বন্ধু, ভারতের পুরনো। তাই যুদ্ধ বাধলে রাশিয়া কোন পক্ষ নেবে বলা মুশকিল। চীনের সঙ্গে জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়।

তাছাড়া ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ও সম্পর্ক গত কয়েক দশকে অনেক দৃঢ় হয়েছে। এরই মধ্যে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে নৌমহড়ায় অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের সঙ্গে সম্মিলিত নৌমহড়ায় অংশ নেয় ভারত। ভারত বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বেশ কয়েকটি সামরিক জোটের অংশগ্রহণ করেছে। চীন যদি যুদ্ধে যায় তবে এই অঞ্চলে ইন্দো-মার্কিন জোট তৈরি হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, চীনের রণংদেহী মনোভাবের কারণে জার্মানি ও ইউরোপ থেকে সেনা কমিয়ে এশিয়ায় মোতায়েন করার চিন্তা করছে মার্কিন সরকার। অতএব চীন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করছে।

অন্যদিক ভারত যুদ্ধে যাবে না, যুদ্ধ যাওয়ার যদি অভিপ্রায় থাকত তবে সংঘর্ষের পর ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৎক্ষণাৎ ব্রিকস ও সাংহাই কো-অপারেশন থেকে বের হয়ে আসত। আদৌ সে কাজ করেনি। চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে অর্থনৈতিকভাবে ভারত পিছিয়ে পড়া। বিশ্ব রাজনীতির বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে, অর্থনীতি এখন বিশ্ব রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। উল্টো নিহত সেনাদের কথা বলে ভারত চাইছে বিশ্বের কাছে চীনের আগ্রাসী মনোভাবের কথা তুলে ধরতে। যুদ্ধে না যাওয়ার আরো একটি কারণ হল, সামরিক দিক থেকে চীনের চেয়ে ভারত বহুগুণে পিছানো। আর এই করোনা মহামারির সময় ভারতের মিত্র রাষ্ট্রগুলো ভাইরাস সামলাতে ব্যস্ত, ভারতকে কতটুকু সাহায্য করতে পারবে অনিশ্চয়তা রয়ে যায়। চীন সুযোগ বুঝে মহামারির সময়টাকে বেছে নিয়েছে ভারতকে আক্রমণ করার জন্য।

যাতে ভারত হুংকার তোলার সাহস না রাখে। সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনের শক্তি সম্পর্কে অবগত হয়। যে কাজটি চীন ১৯৬২ সালেও করেছিল।

১৯৬২ সালে এক মাস এক দিনের লড়াইয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে চীন। অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখের অনেকটা অংশ নিয়ে নিয়েছিল, চীনের এই অকষ্মাৎ আক্রমণে প্রস্তুত ছিল না ভারত। চীনের আগ্রাসী আক্রমণে দিশেহারা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে একাধিকবার চিঠি পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিল আমেরিকা। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় হাজির। যার ফলে পারমাণবিক যুদ্ধের একটা আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল।

এমন একটা পরিস্থিতিতে বিশ্বের গণমাধ্যম ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কিউবার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ভারত-চীন নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। সেই সুযোগে ভারত আক্রমণ করে চীন বুঝিয়ে দিল, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার মতো সামর্থ্য চীনের আছে। তাই বলাই যায়, বৃহৎ আঙিকে ভারতকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে ঘিরে ফেলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে চীন। সেই প্রয়াসে সাড়া দিয়ে নেপাল ইতোমধ্যে ভারতের বলয় থেকে বের হয়ে চীনের বলয়ে ঢুকে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলো কী করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

অরিত্র দাস : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 
Electronic Paper