ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

লঞ্চডুবি, তদন্ত কমিটি, অতঃপর...

সাহাদাৎ রানা
🕐 ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০২, ২০২০

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। তাই সারা দেশের সঙ্গেই নৌ-পথের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা। সড়ক পথ, নৌ-পথ ও আকাশ পথের মধ্যে মানুষ চলাচলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করেন নৌ-পথকে। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত কারণও। যেমন নৌ-পথে নেই যানজটের ভাবনা, নেই ধুলাবালির যন্ত্রণা। আছে নির্মল বাতাসে ভ্রমণ উপভোগ করার প্রশান্তি, আছে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তাও।

মূলত এসব কারণে মানুষ অন্য পথের চেয়ে তুলনামূলক নৌ-পথে চলাচল করতে বেশি আনন্দ পায়, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই আনন্দ রূপ নেয় বিষাদে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনা সেই তথ্যই দিচ্ছে নতুন করে। যেখানে মারা গেছেন প্রায় ৩২ জন মানুষ। আরামদায়ক ভ্রমণ হলেও নানা কারণে আমাদের দেশে লঞ্চে যাতায়াত এখনও নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। এ কারণে কিছু দিন পরপর লঞ্চডুবির ঘটনা আমরা লক্ষ করি। প্রায় প্রতি বছরই ছোট-বড় নৌ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা আমাদের ভাণ্ডারে।

তবে এসব নিয়ে তাৎক্ষণিক আলোচনা হয় এটাও সত্যি। তখন সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেন। কী করতে হবে, কী করতে হবে না তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। তদন্ত কমিটি হয়। আসে সুপারিশও। কিন্তু সেই সুপারিশের কাগজে ধুলো জমে যায়। কারণ এর বাস্তবায়ন করার জন্য নেওয়া হয় না তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ। কিছু উদ্যোগ নিলেও রিপোর্টের সুপারিশ মেনে চলেন না লঞ্চ মালিকরা। সঠিক তদারকিও হয় না প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

মালিক পক্ষ লঞ্চডুবির ঘটনাকে খুব একটা কেয়ার করেন না। কারণ লঞ্চডুবির ঘটনায় দোষীদের তেমন কোনো শাস্তিও হয় না। তাই লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধে কঠোর শাস্তির বিধানের বিকল্প নেই। যদিও ২০১৭ সালে তৈরি করা অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইনের খসড়া ২০১৮ সালে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়েছিল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। যেখানে ১০ বছরের কারাদ- ও ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্য তা কার্যকর হয়নি। ১০ বছরের সাজা কমিয়ে ৫ বছর আর জরিমানা ৩ লাখ টাকার সুপারিশ করা হয় শেষপর্যন্ত। শাস্তি কমানোর নেপথ্যে ছিল নৌযান মালিক-শ্রমিক নেতাদের চাপ। দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের চাপে শেষপর্যন্ত সাজা কমিয়ে নতুন খসড়াটি তৈরি করা হয়েছে। এখানে আরও দুঃখজনক তথ্য হল- অদক্ষ চালকের অবহেলায় যদি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় তাহলে কী ধরনের সাজা হবে তা খসড়ায় রাখা হয়নি। এমতাবস্থায় যদি আইনটি কার্যকর হয় তবে নৌ দুর্ঘটনা রোধে কতটা কাজে আসবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

আমাদের দেশে মাঝে মাঝে লঞ্চডুবির ঘটনার পেছনে রয়েছে অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ। প্রথম কারণ হল লঞ্চগুলোর বেহাল অবস্থা। বিশেষ করে ছোট রুটে হাতেগোনা কিছু লঞ্চ ছাড়া দেশের অধিকাংশ লঞ্চই চলাচলের অনুপযোগী। দীর্ঘদিন চলার কারণে অনেক লঞ্চ মেয়াদোত্তীর্ণ, হয়ে গেছে লক্করঝক্কর। বিভিন্ন স্থানে স্টিলের পাত ভেঙে আরও বেহাল অবস্থা। যা যাত্রীদের চলাচলের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

শুধু তাই নয়, এসব লঞ্চগুলো প্রায়ই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। এছাড়া রয়েছে অদক্ষ চালক। যাদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই সার্টিফিকেটও। মাঝে মাঝে মাঝ নদীতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ। কারণ জানতে চাইলে স্টাফরা জানান ইঞ্জিন পুরাতন। ইঞ্জিন পুরাতন হওয়াটাও দোষের নয়। কারণ এসব লঞ্চের ইঞ্জিনের বয়সও নেহায়েত কম নয়। কমপক্ষে ২৫ বছর আগের এসব ইঞ্জিন দিয়ে লঞ্চগুলো যে চলছে সেটাও বড় কথা।

শুধু ইঞ্জিন নয়, লঞ্চের ফিসনেটও ভালো নেই। কয়েক বছর পর পর মালিকরা শুধু রঙ লাগিয়ে নতুনের মতো করে তাদের দায়িত্ব এড়ান। এছাড়া আরও অনেক অসুখে আক্রান্ত দেশের অসংখ্য লঞ্চ! অনেক লঞ্চের নেই হেডলাইট। বাতি ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে রাতের বেলা লঞ্চ চলাচল করে। এছাড়া রয়েছে নদী পথে বালুবাহী বাল্কহেডের ভয়। মাঝে মাঝে এসব জলযানের সঙ্গে সংঘর্ষে পতিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতসব ঝুঁকির মধ্যেও লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন লঞ্চে চলাচল করেন।

সাধারণত আমাদের দেশে সড়ক পথে যানবাহনের গতির প্রতিযোগিতা চলে। বিশেষ করে বাস ও ট্রাকের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় সবচেয়ে বেশি। কার আগে কে যাবে এ যেন অলিম্পিক গেমসের কোন স্বর্ণ জয়ের ইভেন্টের লড়াই। সড়ক পথ ছেড়ে এখন সেই প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় নদী পথে নৌযানগুলোর মধ্যেও। বেপরোয়া লঞ্চ চালনা, একটির গায়ে ওপরটি উঠে যাওয়া, মাঝ নদীতে ধাক্কাধাক্কি করা এসব যেন নিয়মিত চিত্র। এতে মাঝে মাঝে ঘটে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এখানে আরও একটি সমস্যা রয়েছে যা অনেকটা আড়ালে থেকে যায়।

দুর্ঘটনা ঘটার পর উদ্ধারকারী জাহাজের বিলম্বে উপস্থিতি। বিলম্বে উপস্থিত হলেও ডুবে যাওয়া নৌযানটি তুলতে মাঝে মাঝে অক্ষম হয় সেই উদ্ধারকারী জাহাজটি। তাই এই বিষয়টির সঙ্গে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টিও প্রশ্নের সম্মুখীন। সব সময়ই লক্ষ করা যায় নৌযান দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা দেওয়া হয়। মৃত্যুর কোনো ক্ষতিপূরণ না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে অর্থ সহায়তা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে তার চেয়ে ভালো হবে ভবিষ্যতে যেন কোনো মৃত পরিবারকে অর্থ সহায়তা দিতে না হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া। অথাৎ কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কীভাবে নৌ দুর্ঘটনা এড়ানো যায় সেই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা।

আমাদের দেশে লঞ্চ শিল্প অনেকখানি এগিয়েছে। অনেক বড় বড় লঞ্চ চলছে বিভিন্ন রুটে। এটা সত্যিই ইতিবাচক খবর। বিপরীতে কিছু নেতিবাচক তথ্যও রয়েছে। দেশে অসংখ্য ছোট ছোট লঞ্চ চলাচল করে। বিশেষ করে বড় নদীতে ছোট লঞ্চের সংখ্যা যথেষ্ট ভয়ের। কিন্তু এত ছোট লঞ্চ বড় নদীতে চলার অনুমতি কেন দেওয়া হয় এটা একটি প্রশ্ন। কার স্বার্থ জড়িত এসব অনুমতির ক্ষেত্রে।

 সামনেই ঝড়ের মৌসুম। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এই সময়ে নৌ দুর্ঘটনার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। এবার যেন তেমন কিছু না হয় সেই বিষয়ে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। ঝড়ের পূর্বাভাস থাকলে লঞ্চ চলাচলে বিধিনিষেধ দিতে হবে। লঞ্চ মালিকদের বলে দিতে হবে নদীতে ঝড় শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে পারে নোঙর করার কথা। এই বিষয়ে মালিকদেরও বাড়তি দায়িত্ব রয়েছে। কেননা, লঞ্চ দুর্ঘটনায় পতিত হলে মালিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই কোনো মালিক নিশ্চয়্ই চাইবেন না ক্ষতিগ্রস্ত হতে। এর জন্য মালিকদের পক্ষ থেকে চালকদের বিশেষভাবে সতর্ক করে দিতে হবে।

পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোধেই সংশ্লিষ্ট আইন ও তার বাস্তবায়নে আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, লঞ্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে সঠিক নকশা অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা, লঞ্চের ফিটনেস তদারকি করাও প্রয়োজন নিয়মিতভাবে। এছাড়া মাস্টার ও সুকানিদের প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট রয়েছে কিনা সেটাও যাচাই করতে হবে। আর এসব বিষয় মনিটরিং করতে হবে নিয়মিতভাবে। তবেই হয়ত কমে আসবে লঞ্চ দুর্ঘটনা।

 

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

 
Electronic Paper