ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বন্যার ছোবল যেন ‘যস্মিন দেশে যদাচার’!

রীমা রানী সাহা
🕐 ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০২, ২০২০

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের এই সংকটের মধ্যে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আম্পানের তাণ্ডবে দেশের পশ্চিমাঞ্চল পুরোপুরিভাবে এখনো সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এরই মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে একযোগে বন্যা দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বন্যার ঢেউ লাগতে পারে দেশের মধ্যাঞ্চলেও। বাংলাদেশে বন্যার কারণ মূলত দুটি।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি। ভারতের পূর্বাঞ্চল বা উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এবং দেশে অব্যাহত বৃষ্টির কারণে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আর তিনটি বড় নদী তথা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার মোট আয়তন প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার।

যা বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে ১৪ গুণের কাছাকাছি। পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা, ধরলা, দুধকুমার, সোমেশ^রী, আত্রাইসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে রয়েছে। ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জামালপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা বন্যা কবলিত হয়েছে।

ভারতের মেঘালয়, আসাম ও দার্জিলিংসহ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অতিবৃষ্টির প্রভাব বাংলাদেশের নদ-নদীর ওপর এসে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চল হয়ে বন্যার পানি মেঘনার দিকে এবং যমুনা দিয়ে পদ্মায় প্রবেশ করলে তা মধ্যাঞ্চলের ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করতে পারে। বন্যা এমন একটা সময় দেখা দিল যখন মাঠে এখন আমনের বীজতলা, আখ, ভুট্টা, পাট ও গ্রীষ্মকালীন সবজি। ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিলেট, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় বহু বাড়িঘর বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে।

পুকুর, ফসল তলিয়ে গেছে। বহু মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবার দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। নদীতীরবর্তী এলাকার শত শত ঘর বন্যার কারণে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম এলেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হবে, ফসলহানি ঘটবে, নদীভাঙন হবে, বাড়িঘর বিলীন হবে, বাস্তুচ্যুত ঘটবে, প্রাণহানি হবে; এ যেন যস্মিন দেশে যদাচার!

গত বছরও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা হয়েছিল জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে। তলিয়ে গিয়েছিল অনেক জেলা। সে তুলনায় বন্যা এবার বেশ আগেই হাজির হয়েছে। তিস্তার পানি নিয়মিতভাবেই বাড়ছে। যে তিস্তা নদী বছরের বেশিরভাগ সময় পানির অভাবে হাহাকার করে সেই তিস্তার ভাঙনে এখন সব হারানোর আতঙ্কে ভুগছে হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি মোকাবেলা করা না গেলে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা দেখা দিতে পারে!

বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। হিমালয় থেকে আসা জলের সঙ্গে পলি এসে এদেশের অনেক এলাকা গড়ে উঠেছে। হিমালয় থেকে আসা বরফ গলা পানি ও অতিবৃষ্টির পানি বিভিন্ন প্লাবনভূমি ও নদ-নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়।

তথ্য মতে, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়, তার ৯০ ভাগের বেশি আসে উজান থেকে। ভৌগোলিক বাস্তবতায় বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানোর সুযোগ খুব একটা নেই বললেই চলে। ফলে বর্ষা মৌসুমে বন্যার ছোবল প্রায় প্রতিবছর যেন অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে! পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিবছর এই সময়টাতে সম্ভাব্য বন্যা মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ খুব কমই দেখা যায়। বৃষ্টির পানি জমার ক্ষেত্রগুলো হল খাল-বিল, নদী-নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়।

দুঃখের বিষয় অধিকাংশ নদনদী, খাল-বিল ভরাট হয়ে গেছে। অগভীর জলাশয়গুলো পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে। নদ-নদীগুলোর পরিকল্পিত ড্রেজিং বন্যা মোকাবেলা ও ভাঙন রোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। নদী ভরাটের কারণে প্রতিবছর দেখা দিচ্ছে বন্যা, বাড়ছে নদীভাঙন। বন্যার সময় টেকসই বাঁধ নদী তীরবর্তী মানুষ বড় সহায়। ভেঙে যাওয়া নদী তীর রক্ষা বাঁধগুলোর সংস্কার ও স্থায়ীভাবে মেরামত না করার কারণে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে নদী তীরের বাসিন্দাদের।

প্রাকৃতিক বিষয়গুলো মোটামুটি নির্ধারিতই বলা চলে! কিন্তু তাই বলে প্রতিবছর একই পরিণতি ভোগ করতে হবে? বন্যা মোকাবেলায় টেকসই ব্যবস্থা ও আগাম প্রস্তুতির কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা জরুরি। নদ-নদীসহ সব ধরনের জলাশয়ে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পরিকল্পিত জ্রেজিং ও বাঁধ সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। করোনাকালে এমনিতেই গরিব ও অভাবি মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এ সময় বন্যার ছোবল ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকার অধিবাসীদের জন্য এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ, ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রস্তুত রাখতে হবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষক ও গরিবদের সহায়তায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।

রীমা রানী সাহা, মাশিমপুর, শিকদারহাট, সদর দিনাজপুর থেকে

[email protected]

 
Electronic Paper