ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শিল্পীর সামাজিক দায়

আকমল হোসেন
🕐 ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২০

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করাই তার স্বভাব। প্রাণসর্বস্ব মানুষ থেকে যার যাত্রা আর আজকের সভ্যসমাজ তার বর্তমান গতিবিধি সুদূরপ্রসারিত। যে মানুষ সমাজে বাস করে না সে হয় দেবতা নয়তো পাগল। জীব মাত্রেই নানাবিধ চাহিদা আছে, সেই চাহিদা মেটাতেই তাকে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হয়। দেবতা ছাড়া মানুষ চলতে পারে কিনা জানি না তবে মানুষ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না, সেটা পরিষ্কার।

ব্যক্তি মানুষের সমাজের জন্য বিবেকী দায়বদ্ধতার সঙ্গে আইনি দায়বদ্ধতা আছে। বিবেকী দায়বদ্ধতার জন্য অন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তবে আইনি দায়বদ্ধতার জন্য জবাবদিহি করতে হয়। তবে সচেতন, সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য আইনি দায়বদ্ধতার চেয়ে বিবেকী দায়বদ্ধতার বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সমাজের অগ্রসরমান অংশের যেমন প্রধান অংশ সেই সঙ্গে সম্মানিতও বটে। সেই কারণে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও বেশি।

কবি পার্শিবিসি তো বলেছেনই, কবিরা সমাজের নীরব সংস্কারক। এরা নিভৃতে সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যায়। সাহিত্যিক ও শিল্পীদের কর্মকাণ্ড এক সময় ছিল অদৃশ্য শক্তি দেবদেবী, শাসক আর বিত্তশালীদের ঘিরে। মধ্যযুগের সাহিত্যেকর্ম ও লেখালেখিতে তার চিত্র পাওয়া যায়। ফলে সাম্প্রদায়িক চর্চা, বিভেদের চর্চা এক সময়ে হয়েছে, এখনো হয়। সাম্প্রতিককালে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে হিন্দু মৌলবাদী ক্ষমতাসীন বিজেপির দ্বারা গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে তাদের দলের কর্মীদের দ্বারা নিগ্রহের খবর প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে।

ইউরোপের রেনেসাঁ/ পুনর্জাগরণ, ফরাসি বিপ্লব, সর্বশেষ রুশ বিপ্লব, সংস্কৃতি ও সংগীতের বিষয়বস্তুকে করেছে মানুষমুখী, জীবনমুখী। শাসক রাজার ১২ দিনের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী তারই উজিরের ১২ বছরের কন্যা তাজেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা বাংলা যাত্রাপালার ঘটনা।

এখানে সাহিত্যে অন্ধ ও কুসংস্কার যেমন প্রশ্রয় পেয়েছে পাশাপাশি জোরপূর্বক ১২ দিনের শিশুর সঙ্গে ১২ বছরের কন্যার বিবাহ দিতে বাধ্য করা, ক্ষমতার প্রদর্শন ঘটেছে। প্রতিবাদ এসেছে উজিরের কাছ থেকে। বাবার ওপর নেমে আসা নির্যাতন সেই নির্যাতন বন্ধ করতে ১২ বছরের কন্যা তাজেলকে ১২ দিনের শিশু রহিমের সঙ্গে বিবাহের সম্মতি দিতে হয়েছে। এ ঘটনার সাহিত্য রূপদানকারী নাট্যকারের বিপদের মুখোমুখি হতে হয়নি কারণ তিনি ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন, মন্তব্য করেনি। কথায় বলে হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন হাকিমও নড়ে আবার হুকুমও নড়ে।

পিরোজপুরে এক সময় সরকারদলীয় এক নেতা দুর্নীতির কারণে গ্রেফতার এবং তার জামিন বাতিল হলে জামিন বাতিলকারী বিচারককে স্ট্যান্ডরিলিজ এবং ৪ ঘণ্টার মধ্যে নতুন বিচারক নিয়োগ দান এবং জামিন দেওয়ার ঘটনা আমাদের দেশের খুব বেশি সংখ্যক মানুষকে চিন্তিত করেনি। শাসক ভজন, ক্ষমতার তোষণ এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? সাহিত্যিকদের বশ করে রাখার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার আর সফরসঙ্গী করার লোভ কে সংবরণ করতে পারে! হ্যাঁ পারে। যারা পারে তারাই প্রকৃত লেখক। যারা পারে না তারাও লেখক! তারা রাজসভার অনুগত। এদের লেখায় শাসকের ভুল ধরা পড়ে না। তবে এরা বেশি দিন বাঁচে না। শাসকের ক্ষমতা যতদিন থাকে এরাও ততদিন বেঁচে থাকে। আর মরে-মরে যারা বেঁচে থাকে তারাই বেঁচে থাকে মৃত্যুর পরও। তারাই লেখক।

বিশ্বখ্যাত রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন সত্যিকার লেখক হতে হলে, তাকে কল্পনা, স্বপ্ন, সততা, বিজ্ঞানমনস্কতা আর পরিবর্তনের চিন্তা মাথায় থাকতে হবে। এগুলোর চর্চা করতে গেলে প্রচলিত এবং মানুষের স্বার্থবিরোধী কাজের বিপক্ষে তার অবস্থান নিতে হয়। আর এ অবস্থান নেওয়ার কারণেই সক্রেটিসের বিরুদ্ধে শাসক ক্ষেপেছিলেন। কারণ যুবসমাজ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছিল। শাসক তার ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তার ক্ষমতা শঙ্কামুক্ত করতে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে শাসকের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার তথাকথিত অভিযোগে প্রহসনমূলক বিচারে হত্যা করেছিল।

ফরাসি বিপ্লবের নায়ক ভলটেয়ারকে সন্ত্রাসীদের দ্বারা তৎকালীন মৌলবাদী শাসক হামলা করিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অধিকার আদায়ে কবি নজরুল ইসলামকে জেল জুলুম হুলিয়ার শিকার হতে হয়েছে। জার্মানির নাৎসি বাহিনী ও হিটলারের আক্রমণে সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল রাজনীতিক বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে।

বুদ্ধিজীবীরা নিপাত যাক তারা এই সেøাগান তুলেছিল। স্পেনের কবি ফেদেরিকোকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, সে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। ধর্মীয় ব্যবসা এরং কুসংস্কারের বিপক্ষে কথা বলায় কাজী নজরুল ইসলাম, ওমর খৈয়ামকে কাফের আখ্যা শুনতে হয়েছে। গ্যালিলিওকে সত্য বলায় আট বছর জেল খাটতে হয়েছে। কোপার্নিকাসকে তার আজীবনকালে চিন্তাকে প্রকাশ করতে দেয়নি। একইভাবে আরজ আলী মাতুবরকেও পাকিস্তান আমলে তার চিন্তাকে প্রচার করতে দেয়নি। ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।  জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করায় বিজ্ঞানী হাইপোর্সিয়াকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

কৃষি ও আবহাওয়া নিয়ে যুক্তিসঙ্গত প্রবচন বলার কারণে খনার জিহ্বা কেটে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানিদের শোষণ ও নির্যাতনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হানসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। কবিতা লেখার তথাকথিত অপরাধে দাউদ হায়দার, লেখার মাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের কারণে তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হচ্ছে। হুমায়ুন আজাদ, অভিজিত রায়ের মতো মানুষকে স্বাধীন মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

শাসকরা এ সব ঘটনার বিচারে আগ্রহী নয়। সত্যিকার শিল্পী যারা, তাদের জীবনে ম্যাক্সিম গোর্কির সেই উক্তিই প্রযোজ্য। সত্যিকার লেখকের জন্য কল্পনা স্বপ্ন সততা বিজ্ঞানমনস্কতা আর পৃথিবীটাকে পরিবর্তনের চিন্তাকে লালন করেছিলেন তারা ঢোলের লাউ আর অম্লের কদু হননি। শাসক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের রূপের পরিবর্তন ঘটাননি। তারা চিটা ধানও নন, বাতাসের আগে উড়ে যাবেন। লোভ লালসা ভয়-ডরকে উপেক্ষা করে দেশ-জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মরেও অমর হয়ে আছেন। আর রাজসভার কবি, শাসকভজা লেখক, কর্তাভজা বুদ্ধিজীবীদের দিন শেষ হয়ে যায় শাসকের গদি উল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে। মানুষ জ্ঞানের আধার, সেই মানুষকে উপেক্ষা করে শাসক ভজে সাহিত্যচর্চা করে কে কবে টিকে ছিল বা আছে সেটা ভাবলে কবি লেখক শিল্পীর দায় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব!

আকমল হোসেন : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) কেন্দ্রীয় কমিটি

 
Electronic Paper