ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাংলাদেশ

মোহাম্মদ নজাবত আলী
🕐 ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের মানুষ ধৈর্যশীল, সাহসী ও কষ্টসহিষ্ণু। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জাতি হিসেবে বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অদম্য সাহসী এদেশের মানুষ। প্রতিনিয়ত ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে টিকে আছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝেও বাঙালির মনোবল কখনো দুর্বল হয়নি। দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন বাঙালি জাতি সবসময় এগিয়ে চলেছে। কোনো কিছুতেই তারা হার মানতে জানে না। সাময়িকভাবে কিছুটা দুর্বল হলেও দ্রুত গতিতে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম।

এবার সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাত ও কালবৈশাখীতে দেশব্যাপী বোরো ধানের ক্ষতি হলেও জাতীয় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদিত বোরো ধানে ২ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে। এ বছর মোট ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। ঝড়, বৃষ্টি, সাইক্লোনসহ বিভিন্ন দুর্যোগে যে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বাদ দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

সুতরাং আম্পান কালবৈশাখী বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দেশব্যাপী বোরো ধানের যে ক্ষতি হয়েছে এটা না হলে সেটা হতো লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত। তাই তারা জোর দিয়েই বলছেন, সরকার বোরো ধান-চালের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা পূরণ হবে। এবারে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সারা দেশে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়। এবারের হাওরের ৭ জেলায় ধান উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে।

এর মধ্যে শুধু হাওরেই ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। হাওর অঞ্চলে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। সারা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ২০ ভাগ ধান উৎপাদন হয় হাওর অঞ্চলে। এবার সরকারের সহায়তায় হাওর অঞ্চলে মোট ৩৬২টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ১০৫৬টি রিপার সরবরাহের ফলে দ্রুত ফসল ঘরে ওঠার কারণে সরকারের ধান চালের লক্ষ্যমাত্রার কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। ফলে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।

দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ রোল মডেল। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিনির্বাপণের মতো দুর্যোগ ক্ষয়ক্ষতি যাতে হ্রাস পায় সে জন্য যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার ইতোমধ্যেই তা নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড় থেকে জনগণের জান-মাল রক্ষায় ১৭২টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। তাছাড়াও ৩২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবক, ২৪ লাখ আনসার ভিডিপি, ১৭ লাখ স্কাউট, ৪ লাখ বিএনসিসি, গার্লস গাইডের প্রায় ৪ লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য রয়েছে।

এবার সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্পানে এ সমস্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে প্রায় ২৪ লাখ লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ায় প্রাণহানি কম হয়। তাই যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় তারা সদাপ্রস্তুত। তাছাড়াও সমুদ্র উপকূলের ৩৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন সেন্টার বর্তমান সরকার নির্মাণ করেছে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর যে কোনো দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনেকাংশে নির্ভরশীল। কখনও বন্যা, ঝড়ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, কৃষি আবাদি জমি ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এমনিভাবে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশবাসীর সাজানো সংসার মুহূর্তের জন্য তছনছ করে ফেললেও অদম্য দেশবাসী কখনো ভেঙে পড়েনি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা-খরার ওপর মানুষের হাত নেই। এদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম প্রধান কারণ অতিবৃষ্টি, নদীভাঙন এবং দেশের উপকূলবর্তী দক্ষিণাঞ্চলে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। তবে নদীভাঙন রোধকল্পে এবং বন্যা প্রতিরোধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষগুলোকে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আগেই সরাসরি বেসরকারিভাবে রেডিও, টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়। ফলে ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া যায়। যেমন আম্পানে নেওয়া হয়।

প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং দুর্যোগ পরবর্তীকালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়ে পুনর্বাসন প্রকল্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার জন্য সরকারের একটি বিশেষ মন্ত্রণালয় রয়েছে, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় নামে পরিচিত। আর্থিক সাহায্য ছাড়াও উপকূলবর্তী অঞ্চলে আশ্রয়ণ প্রকল্প খোলা হয়েছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর এদেশের প্রচুর সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এদেশের বহু মানুষ ঘর-বাড়ি বসত ভিটা, ধন-সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।

ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের আগাম খবর পাওয়া আজকের বিজ্ঞানের যুগে কঠিন নয়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি অভিশাপ। তবে এ বিপর্যয় থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, কীভাবে জানমালের ক্ষতি কমানো যায় এ ব্যাপারে সারা বিশ্বে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে আগাম সতর্কবার্তা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন, পুনর্গঠন (আশ্রয়ণ প্রকল্প) দুর্যোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে দুর্যোগ কমানোর লক্ষ্যে সামাজিক বনায়ন যা ইতোমধ্যে সরকার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

তবে একদিকে দেশবাসীর অদম্য সাহস, অন্যদিকে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণকে আরও সাহস জুগিয়েছে। সুতরাং বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প এ সবই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে। এ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে। আর এ সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভিন্ন নামও রয়েছে। কখনও সাইক্লোন, কখনও হ্যারিকেন, কখনও ক্যাটরিনা, কখনও সিডর, কখনও নার্গিস, কখনও আইলা আবার কখনো রোয়ানু।

বলতে কোনো দ্বিধা নেই, বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তবে এ দুর্যোগ সাধারণত দুধরনের মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, সভ্যতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেও শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পাহাড় কাটা, নদীর তীরের মাটি খনন, বন উজাড় ইত্যাদি করে। প্রতি বছর পাহাড় ধসে বহু মানুষ মারা যায়। নদীর পাড় কাটার কারণে বন্যায় নদীভাঙনে মানুষের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বন উজাড় করার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জনজীবনে। তবে বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সিডর, আইলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেই এদেশের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। প্রায় ফি বছর ছোট বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট নেমে আসে এদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেন দেশবাসীর নিত্যসঙ্গী।

প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এদেশের মানুষ চরম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের হাত না থাকলেও সতর্কতা অবলম্বন করলে জান-মাল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। নিকট অতীতে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়। সরকারের আগাম সতর্কবার্তা ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষতির পরিমাণ কম। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশের মানুষের দৃঢ় মনোবল ও অদম্য সাহস আত্মবিশ্বাস বাড়লেও প্রতি বছর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে সবসময় একটি আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়, যা অনেকটা কমেছে।

এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষাকল্পে সরকারকে আরও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। সতর্কমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও জনগণের সচেতনতা বাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি এড়াতে উপকূলীয় এলাকায় আবহাওয়া বার্তা আধুনিকায়নের পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলের ৩৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন সেন্টার বর্তমান সরকার নির্মাণ করে।

সাম্প্রতিক অতীতের সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সতর্কতা ও পূর্ব প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই। দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ বেশ সক্রিয়। সরকারও তৎপর। নদীভাঙন, বন্যা, ঝড়, পাহাড় ধসÑ এককথায় মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দুর্যোগের ভয়াবহতা। কিন্তু এত ক্ষয়ক্ষতির মাঝেও দেশবাসী ঘুরে দাঁড়িয়েছে সবসময়। অদম্য সাহসী দেশবাসী ভেঙে পড়েনি কখনও। বুকে সাহস নিয়ে জীবনসংগ্রামে টিকে রয়েছে। ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতও তারা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে এবং ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের হাত নেই। তবুও আগাম প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি সরকার গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করায় সাধারণ জনগণের জানমাল যেমন রক্ষা পাবে তেমনি অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

মোহাম্মদ নজাবত আলী : শিক্ষক ও

কলাম লেখক

 
Electronic Paper