ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাড়ছে ভূগর্ভস্থের পানিদূষণ

জান্নাতুল মাওয়া নাজ
🕐 ৮:৪৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০

পানিসম্পদ হলো পানির সেই সমস্ত উৎস যেগুলো মানুষের নিয়মিত ব্যবহারের জন্য অতিপ্রয়োজনীয়। কৃষি, শিল্প, গার্হস্থ্য ব্যবহার এবং পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণসহ মনুষ্যজীবনের সর্বক্ষেত্রেই পানির ব্যবহার অপরিহার্য এবং এই সব কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেটি অত্যাবশ্যক সেটি হলো পরিশোধিত বিশুদ্ধ পানি। পানির প্রধান তিনটি উৎস হলো বৃষ্টির পানি, ভূ-পৃষ্ঠের উপরের পানি ও ভূগর্ভস্থ পানি।

এর সবকটির ক্ষেত্রেই দূষণ ঘটে। ভূ-পৃষ্ঠের উপরের পানি ভূগর্ভস্থ পানির তুলনায় অধিক সংবেদনশীল বা তুলনামূলকভাবে সহজে প্রভাবিত হয়, যেহেতু ভূগর্ভস্থ পানি প্রাকৃতিকভাবেই ভূ-পৃষ্ঠের উপরের ক্রিয়াকা- থেকে সুরক্ষিত। কিন্তু বহুমুখী দূষণের কবলে পড়ে সেই পানিই এখন মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দূষিত পানি পানের কারণে মানুষ ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভারসহ নানা জটিল ও প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

পৃথিবীতে লভ্য পানির প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ হলো লবণাক্ত এবং বাকি মাত্র ২.৫ শতাংশ বিশুদ্ধ। এই স্বল্পপরিমাণ শুদ্ধ পানির আবার দুই-তৃতীয়াংশই কঠিন অবস্থায়। অবশিষ্ট তরল পানির অধিকাংশই ভূগর্ভস্থ এবং অতি অল্পপরিমাণ পানি ভূপৃষ্ঠস্থ জলাশয়ে লভ্য। ভূগর্ভস্থ পানি উপরিভাগের পানির তুলনায় অধিকতর সুবিধাজনক এবং কম দূষণের শিকার হয়। তাই এটি সাধারণত সর্বজনীন পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহারযোগ্য পানির সর্ববৃহৎ উৎসের জোগান দেয় ভূগর্ভস্থ পানি এবং সব প্রদেশের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া বছরে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট লেকস-সহ সব হ্রদ এবং জলাশয়গুলোর চেয়ে ভূগর্ভের জলাধারগুলো অনেক বেশি পানি ধারণ করে। নগরকেন্দ্রিক পানি সরবরাহের অধিকাংশই ভূগর্ভস্থ পানি থেকে আহরণ করা হয়।

বাংলাদেশে প্রায় শতভাগ গ্রামের মানুষ খাবার পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। শহর অঞ্চলেও পানির সরবরাহ প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। রাজধানী ঢাকায় মোট জল সরবরাহের ৮৭ শতাংশের বেশি আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে, বাকিটা ভূপৃষ্ঠস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে আসে। ভূগর্ভস্থ পানি সেচ কাজেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট সেচের ৭২ শতাংশ পানি উত্তোলিত হয় ভূগর্ভ থেকে যা পরিমাণে অনেক।

মহাপরিকল্পনা সংস্থার ১৯৮৯ সালের জরিপ থেকে জানা যায় বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি মজুদ আছে ২,৫৭৫ কোটি ঘনমিটার, যার মধ্যে ১৬৮.৬ কোটি ঘনমিটার উত্তোলনযোগ্য নয়। বাকি মজুদের ৯০ কোটি ঘনমিটার গৃহস্থালি ও শিল্প উৎপাদনে এবং সর্বোচ্চ ১২৮১ কোটি ঘনমিটার কৃষির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে আড়াই কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগের কারণে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে।

আরও বলা হয়, দেশে প্রতিদিন ১০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি রয়েছে। রাজধানীতে প্রতিদিন ২২০ থেকে ৩০০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। গত তিন দশকে ভূগর্ভস্থ পানির জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমানে সারা দেশে বছরে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ মানুষ পানি সংকটে ভুগছে। দেশে মানুষের প্রতিদিন সুপেয় পানির যে চাহিদা রয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সেই চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়।

অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সঙ্গে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ। যা পান করার ফলে মানুষ বিভিন্ন রোগে ভুগছে প্রতিনিয়ত।

ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা বিশুদ্ধ পানি। এই পানির প্রতিটি ফোঁটাই যেন এক অমূল্য সম্পদ। গবেষকরা বলছেন, এতে প্রতি বছর প্রায় ১০ ফুট করে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এ শূন্যস্থান পূরণে রাজধানীর আশপাশের নদী ও অন্যান্য জলাশয় থেকে যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভে জমা হচ্ছে, তা উত্তোলনের তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দূষণ কবলিত এসব জলাশয়ের বিষাক্ত পানি নেমে গিয়ে দূষিত করছে ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তরকে।

দ্বিতীয় স্তর রয়েছে ঝুঁকিতে। আর তৃতীয় স্তর এখন পর্যন্ত নিরাপদ থাকলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। ইতোমধ্যে ঢাকা শহরে ভূগর্ভের প্রথম স্তরে নাইট্রেট, সালফেট, মার্কারি, সীসা, আর্সেনিক ও নানান জৈব কণার উপস্থিতি লক্ষ করছেন গবেষকরা। চাপকল দিয়ে প্রথম স্তরের পানি তোলা হলেও মোটরচালিত অগভীর নলকূপ দিয়ে দ্বিতীয় ও গভীর নলকূপ দিয়ে তৃতীয় স্তর থেকে তোলা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি।

প্রথম স্তরের দূষণের কারণে রাজধানীর নদী-তীরবর্তী এলাকায় চাপকলের পানি এখন অনেকটাই পানের অযোগ্য। ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের বিষয়টি রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে বিজ্ঞানীদের। স্বস্তিতে নেই ওয়াসা কর্তৃপক্ষও। সুপেয় পানির সুরক্ষাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন দায়িত্বশীলরা। ধারণা করা হচ্ছে, নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করে কাজে লাগানো না হলে কয়েক দশকের মধ্যে সুপেয় পানির অভাবে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে ঢাকা।

ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ ঘটে যখন দূষণকারী পদার্থ মাটি থেকে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে। ভূগর্ভস্থ পানিতে ক্ষুদ্র এবং অবাঞ্ছিত উপাদান, দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতির ফলে এই ধরনের দূষণ প্রাকৃতিকভাবেই ঘটতে পারে, এ ক্ষেত্রে এটি দূষণের পরিবর্তে অবিশুদ্ধি হিসেবে উল্লেখ করাই শ্রেয়।

ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুন্ন হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। উভয় প্রকার ঝুঁকির কথা আমাদের সবারই জানা আছে। সে জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয় সব দেশেই। ঢাকা ওয়াসাও এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এই সংস্থা অনেক আগে থেকেই বলে আসছে, রাজধানী ঢাকার মাটির নিচের পানির স্তর বিপজ্জনক হারে নেমে যাওয়ার ফলে ব্যাপক হলে গভীর নলকূপ বসানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক দশক আগে ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ নির্দেশনা সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়েই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কিছু মাত্রায় হলেও কমবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআর ও সিডিসি প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে আবাসিক এলাকা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। তেলের ট্যাঙ্কারের মতো উৎস থেকেও প্রচুর ধাতু, তৈলাক্ত পদার্থ, সীসা, পারদ, দস্তা ও ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত দ্রব্য নদ-নদী ও সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। গত কয়েক বছর বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, শোধনাগার, ছাপাখানা ও বড় শিল্পের তরল বর্জ্য দূষণের অন্যতম কারণ।

অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়ে গ্রামের মানুষ যখন নলকূপের পানির ব্যবহার শুরু করে, তখনই তারা আর্সেনিকের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি দূষিত হয়। এই কীটনাশকে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস থাকে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা মাটির ভেতরে পানিকে বিষাক্ত করে। শহরাঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে পানি দূষিত হওয়ার স্তরটি মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে।

ভূগর্ভস্থ পানি ভূ-পৃষ্ঠের দূষণ কর্মকা-ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। অসংখ্য প্রাকৃতিক এবং মানুষের বিভিন্ন ক্ষতিকর কর্মকা- ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের বিষয়টি আবিষ্কারের পূর্বে ভূগর্ভস্থ পানি নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু আর্সেনিক দূষণকে বর্তমান পৃথিবীর পানি দূষণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি কিছুসংখ্যক মানবসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক উৎসের মাধ্যমে দূষিত হয়। মানবসৃষ্ট উল্লেখযোগ্য উৎসগুলো হলো শিল্পজাত এবং শহরের বর্জ্য নিষ্কাশনে নির্বিচারে ভূ-পৃষ্ঠের জলাশয় ব্যবহার করা। অবাঞ্ছিত নোনাপানি চুইয়ে মাটির নিম্ন স্তরে গিয়েও ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ঘটায়।

প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক। কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সেই সঙ্গে সবাইকে সচেতন হতে হবে যেন যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পানির অপচয় রোধ করতে হবে, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি সীমিত। বিশেষ করে, কৃষিক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে ভবিষ্যতে যাতে ব্যবহার করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই আমরা সহজে পানির চাহিদা মেটাতে পারব এবং ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ রোধ করতে পারব।

 

জান্নাতুল মাওয়া নাজ : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[email protected]

 
Electronic Paper