সংকটে মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী
ওয়াসিম ফারুক
🕐 ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০
মানব জাতি আজ কঠিন সময় পার করছে। প্রত্যেকেরই এক আতঙ্কের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত পার হচ্ছে। করোনাভাইরাসের থাবায় জীবন-জীবিকা সবই স্তব্ধ। পৃথিবীর অনেক দেশই করোনার থাবা থেকে কিছুটা মুক্তি পেলেও আমাদের বাংলাদেশ আজ করোনার থাবায় পুরোই নাস্তানাবুদ। ইতোমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও কম না। দেশের বেশ কয়েকজন সুপরিচিত মানুষের জীবনের অবসান হয়েছে করোনার থাবায়।
আরো কত জীবনের বিনিময় করোনা যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার মাশুলই আজ সমগ্র জাতিকে দিতে হচ্ছে। আর এই মাশুল কত দিন গুনতে হবে সেটাও বলা মুশকিল। যদিও কয়েক দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ সাহেব বলেছিলেন বাংলাদেশে আরো দুই তিন বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ চলবে।
পরে এটা নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে তিনি অবশ্য তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক কী বললেন বা কী প্রত্যাহার করলেন সেটা বড় কথা নয়। সেটা বাস্তবতাও না। কারণ আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সবসময়ই বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন। তারা নিজেদের ভোগবিলাসী জীবনের মাপকাঠিতেই সমগ্র জাতিকে বিবেচনা করেন। তাই তাদের প্রায় প্রতিটি আচরণই আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্টের অন্যতম কারণ।
আমাদের অর্থনীতি সিঙ্গাপুর, কানাডা, আমেরিকা বা যে কোনো উন্নত দেশের কাছাকাছি বলে কর্তাব্যক্তিরা সংসদ বা রাজনীতির মাঠ গরম করলেও সাধারণ মানুষের নজরে আজও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। আমেরিকার প্রতিটি করদাতার জন্য সেই দেশের সরকার বারো শত ডলার ও বাচ্চাদের জন্য পাঁচশত ডলার করে করোনাকালীন সহায়তা প্রদান করলেও আমাদের দেশের পঞ্চাশ লাখ হতদরিদ্র মানুষের জন্য ২৫০০ টাকা প্রদানের কার্যক্রমসহ ত্রাণের খাবার নিয়ে যে কা- জাতি লজ্জার চোখে দেখেছে তা ভুলতে হয়ত একযুগ পার হয়ে যাবে।
গত পহেলা জুন থেকে সরকার তথাকথিত সীমিত আকারে প্রায় সব কিছু উন্মুক্ত করতে থাকলেও অনেক কিছুই আজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমাদের ব্যবসায়ীদের একটি বিরাট অংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়ী। আর আমাদের ব্যবসায়ীদের এই শ্রেণির আজ চরম হতাশা ও বিপদের মধ্যে দিন পার করছেন। বিশেষ করে আমাদের দোকানদার শ্রেণি। বিশেষ প্রয়োজনে গত কয়েক দিন আমাকে রাজধানীর বেশ কিছু বড় ও ছোট শপিং মলে যেতে হয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে আমিও একটি ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই ওই সকল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে ও নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে বলতে পারি, এই দোকানদার শ্রেণি এক মহাসাগরের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগীর কথা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের ভয় ও আতঙ্কের জন্ম নেয়। সেই থেকেই প্রায় সকল ছোট ব্যবসায়ে ভাটা শুরু হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে করোনার আক্রমণ ঠেকাতে মানুষকে ঘরে রাখার জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষের মনে এক ধরনের বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিল সরকার। তারপরও সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের কথা ভেবে নিজেদের ঘরের ভেতর বন্দি করতে বাধ্য হয়েছিল। কিছুদিনের মাথায় পেটে ক্ষুধা ও সরকারের অব্যবস্থাপনা মানুষ করোনার ভয়কে পিছু ফেলে পথে নামতে বাধ্য হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ছাড়া সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই মে মাসের শেষ পর্যন্ত বন্ধ থাকায় প্রায় কয়েক কোটি মানুষ ছিল বেকার। আর এই মানুষগুলো তাদের জমানো সঞ্চয় ও ধার দেনা করে বন্ধের ঐ সময়টা কোনোভাবে পার করতে পারলেও এখন আর কোনো পথই খোলা নাই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার দীর্ঘ এক মাস চললেও ব্যবসার নামে জ্বলছে লাল বাতি।
কোনো দিন দুই চার শত টাকা বিক্রি হলেও প্রায় দিনই শূন্য হাতে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার পরই চার দিক থেকে শুরু হয়েছে নানান অর্থনৈতিক চাপ। বাড়িওয়ালার ভাড়া, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জমিদারের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন। সেই সঙ্গে দীর্ঘ বন্ধ সময়ের বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল। সব মিলিয়ে সত্যি এক মহাবিপদের সময়। ব্যবসায়িক ক্ষতির আরো একটি দিক হলো আমাদের দেশ ধর্মীয়ভাবে মুসলিমপ্রধান, আর মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হল ঈদুল ফিতর। ঈদ উদযাপনের জন্য প্রতিটি মুসলমান সাধ্যমতো পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানান জিনিস কেনেন।
তাই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের বাৎসরিক আায়ের একটি বিরাট অংশ আসে এই ঈদের বেচাকেনা থেকে। এর সঙ্গে ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক আয়ের সিংহভাগই করোনার থাবায় হাতছাড়া। ব্যবসায়ীদের ব্যবসাই আজ গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর দুই উৎসবের ব্যবসার মুনাফার আশায় তাদের সমস্ত সঞ্চয়ই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে শূন্য হাতে সবাই আজ দিশেহারা।
যদিও সরকার ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য নানান ধরনের প্রণোদনার ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেই প্রণোদনার সুষ্ঠু ব্যবহার কতটুকু হচ্ছে বা হবে সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা কখনোই সাধারণ মানুষের স্বার্থে তেমন ব্যবহার হয়েছে বলে কেউ মনে করেন না। একজন সত্যিকারের ব্যবসায়ী বা কৃষক ব্যাংক ঋণের জন্য মাসের পর মাস ব্যাংক কর্মকর্তার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে জুতার তলা ক্ষয় করে নানান অজুহাতে খালি হাতে ফিরতে হয়। কথিত বা নামসর্বস্ব ব্যবসার জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়ে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি লুটপাটের সংবাদ প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে আমাদের শুনতে হয়। তাই সরকার ঘোষিত এই প্রণোদনা ও শুধু কথা আর কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এর সুফল এখন পায়নি আর ভবিষ্যতেও হয়ত গুড়েবালি।
২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসায়ীদের তেমন কাবু করতে পারেনি। তারপর ২০১৩ সালে শেষ দিকের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনেও ব্যবসায় তেমন প্রভাব পড়েনি। ওই সময়েও ব্যবসায়ীদের মনে আশার প্রদীপ জ্বলেছিল। সার্বিকভাবে আজ কেন জানি ব্যবসায়ীদের মনের ভেতর সেই আলো আর জ্বলছে না। চারদিকে অমাবস্যার অন্ধকার। কখন এই মহামারির হাত থেকে জীবন-জীবিকার উদ্ধার হবে। কোনোভাবেই বলা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেনি।
সেটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনো নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। অন্যদিকে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও প্রচ- চাপের মুখে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছে, করোনার প্রভাবের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি এ বছর তিন শতাংশ সংকুচিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতিতে মন্দা পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হবে? আমাদের অর্থনীতি এমন সংকটময় পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বের হয়ে আসবে? প্রশ্ন যতই আসুক এর মধ্যে যদি সরকার আমাদের সাধারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থ রক্ষায় ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং চাটুকারদের এই মুহূর্তে দূরে সরিয়ে রাখে তাহলেই চলমান ও আগামী ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের উদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
ওয়াসিম ফারুক : কলাম লেখক