ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সমাজ জীবনের রূপকার নিমাই ভট্টাচার্য

সাইফুজ্জামান
🕐 ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৮, ২০২০

আমাদের মানস-গঠনে অনেকের সঙ্গে যার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন লেখার জাদুমন্ত্রে। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়, নিমাই ভট্টাচার্য। আটপৌরে গদ্যের ভাষার গাঁথুনি দিয়ে তিনি কাহিনী বিস্তার করতেন। অনেক দিন মেমসাহেব উপন্যাস মায়াবী মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে রেখেছিল। এই সামান্য রচনায় নিমাই ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের মাগুরা মহকুমার শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে তার জন্ম। তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। তার পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। দেশভাগের পর তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হন। অতঃপর তিনি কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন।

১৯৪১ সালে তিনি যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেনি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। নিমাই ভট্টাচার্যের পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর কলকাতায় পাড়ি জমান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। রিপন স্কুল থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৫০-এ আইএ এবং ১৯৫২ সালে বিএ পাস করেন। দীর্ঘদিন দিল্লিতে সাংবাদিকতা করেছেন কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সংসদীয় বিটে। ২৫ বছর রাজনীতিবিদ, সমাজহিতৈষী ও গ্ল্যামার জগতের অনেককে দেখেছেন। তাদের জীবন কথা তার সাহিত্যে উঠে এসেছে।

১৯৬৩ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তারপর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। ক্রমে ১৫০টি গ্রন্থের লেখক জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস ও গল্প রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ১৯৭২ সালে তার মেমসাহেব উপন্যাস চলচ্চিত্রের রূপায়ন ঘটে। মূল চলচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্রে ছিলেন উত্তম কুমার ও অপর্ণা সেন। বাঙালি জীবনের রোমাঞ্চকর রসায়নের অপরূপ বিন্যাস এই উপন্যাস। নিমাই ভট্টাচার্য সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকার কারণে রাজনীতি ও গ্ল্যামার জগতের নানা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।

তার দেখা মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন উঠে আসে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম গ্রন্থ ‘রাজধানীর নেপথ্যে’-এ। বাঙালির মনোস্তত্ত্ব, জীবনের দোলাচল তার লেখার প্রাণশক্তি। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তার মেশার সুযোগ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রধান থেকে শুরু করে নিম্নবর্গের মানুষদের সঙ্গে। তাদের জীবনযাপন, আচরণ, সমাজব্যবস্থা নিমাই ভট্টাচার্যকে আকর্ষণ করেছে। বিষয়গুলো তিনি একীভূত করেছেন সাহিত্যে। ১৯৫০ সালে লোকসেবক পত্রিকার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। তিনি জওহর লাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, মোরারজী দেশাই ও ইন্দিরা গান্ধীর মতো রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিবিদদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। এদের বিদেশযাত্রায় কয়েকবার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি দেশনায়কদের জীবন সম্পর্কে জানতেন। জানা ছিল বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর আদ্যপান্ত, উত্থান-পতন, দুঃখ-বেদনা।

দেশভাগের যন্ত্রণা, মানুষের শরণার্থী জীবনের সংকট, ব্যক্তিগত অনুভব, প্রেম-বিরহ, সংগ্রাম, তার আত্মজৈবনিক রচনার সিংহভাগ জুড়ে আছে। বস্তিবাসী, রাজপথে বাস করা মানুষ, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের আকুতি নিয়ে তিনি অজস্র উপন্যাস রচনা করেছেন। পাঠক খুব সহজেই মিশে যায় তার সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে। এই জাদুকরী স্পর্শে উজ্জীবিত হতে হয়। এংলো ইন্ডিয়ান উপন্যাস তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে। এংলো-ইন্ডিয়ানদের জীবনের অবহেলা, ঘৃণা, বেঁচে থাকার লড়াই তীব্রভাবে নিমাই ভট্টাচার্য বিধৃত করেছেন।

সমকালকে ইতিহাসের আলোকে মিলিয়ে দেওয়ার দক্ষতা তাকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। যৌনতাকে প্রধান উপজীব্য করে তিনি কাহিনী নির্মাণে অগ্রসর হননি। প্রেম, যৌনতা, মানবিকতা এসেছে স্বাভাবিক প্রয়োজনে। রগরগে কাহিনী বানিয়ে তিনি পাঠক আকৃষ্ট করেননি। নিমাই ভট্টাচার্য জীবন-জীবিকার মধ্যকার সম্পর্ক, মনুষ্যত্বের নিষ্ঠুরতা ও বাস্তবকে মর্মস্পর্শী ভাবনায় উপস্থাপন করেছেন। সাধারণ উপস্থাপনা অসাধারণ হয়ে উঠেছে প্রকাশশৈলী ও কুশলতার কারণে। দেশান্তরী হওয়ার কষ্ট তিনি ধারণ করেছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিমাই ভট্টাচার্য সহায়তা করেছিলেন।

এক অসাম্প্রদায়িক পৃথিবীর স্বপ্ন তিনি দেখতেন। প্রান্তিক মানুষের যুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বেঁচে থাকার বিভিন্ন অনুষঙ্গ তার আগ্রহের বিষয় ছিল। পরমত সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, মানবিক আকুতি তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক প্রযুক্তি ও জীবনব্যবস্থা যখন উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করছে তখন বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিমাই ভট্টাচার্য প্রান্তিক জনগণ, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের সংস্কৃতি ও স্বজাতির সম্পদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। বিশ্ব নাগরিক আজ তার স্বদেশ, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে ধারণ করে বেড়ে উঠুক এটাই ছিল তার প্রত্যাশা। ২০২০ সালের ২৫ জুন তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। জীবনের ক্লেদ, বিষণœতা আর মনোজগতের অন্ধকার থেকে ঘুরে দাঁড়াবার প্রেরণা নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য। তার সাহিত্য এক রত্নভাণ্ডার এই রত্নভাণ্ডার থেকে মণি-মানিক্য উদ্ধার করতে পারলে আমরা জগৎ সংসার ও মানুষকে চিনতে পারব।

নিমাই ভট্টাচার্যের মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। একটি যুগ যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সমকালকে তিনি ধারণ করেছিলেন। বহতা জীবনের বহুমাত্রিক দিক স্বার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন সাহিত্যে। তার অমর সৃষ্টি অবশ্যই পাঠ্য। পাঠে, স্মরণে, স্মৃতিতে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

সাইফুজ্জামান : কবি ও প্রাবন্ধিক; উপ-কীপার, জাতীয় জাদুঘর

[email protected]

 
Electronic Paper