ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বৈদেশিক বিনিয়োগে বাংলাদেশ কতটা সক্ষম

প্রণব রায়
🕐 ৭:০২ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২০

বৈদেশিক বিনিয়োগ এদেশে করোনা পরবর্তী অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এতে সন্দেহ নেই। বর্তমান সময়ে চীনের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশসহ কতিপয় দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে সকল সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধান করে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ সম্ভব। প্রথমে জেনে নেওয়া যাক বৈদেশিক বিনিয়োগ কী। বৈদেশিক বিনিয়োগ হল বিদেশ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে, বহুজাতিক কোম্পানিরূপে বা সরাসরি বিদেশি সরকার ও তাদের এজেন্ট কর্তৃক কোনো দেশে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও সমস্যাগুলো তুলে ধরছি।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। গত দশ বছরে যেভাবে দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী হয়েছে তাতে এদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বিগত বছরগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, নেতিবাচক রাজনৈতিক অবস্থায়ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়েছেন। উল্লেখ্য ২০১৩ সালে যদিও দেশে সহিংসতা, আত্মবিধ্বংসী ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল, তদুপরি ২৪ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত দশ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, ভারতের পরেই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে।

২০১৩ সালে ভারতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে একই বছর পাকিস্তানে এর পরিমাণ ছিল ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিশেষত গত বিশ বছরে ক্রমশ দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সামষ্টিক চলকগুলোর ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর অবকাশ সুবিধা প্রদান, কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস এবং ভাবমূর্তি উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে অবকাঠামো চাহিদা অনুযায়ী হতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের অবকাঠামো আশানুরূপ নয় বিধায় বিদেশিরা সহজে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে না। তবে ইতোমধ্যে অনেক দেশ বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ শুরু করে দিয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে বেশির ভাগ মানুষ বেকার। বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে বিদেশিরা তাদের কলকারখানায় সহজে কম পারিশ্রমিকে এই বেকার জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। এতে বেকার সমস্যার সমাধানেও বিশাল সম্ভাবনা দেখা দেবে। বিদেশিদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে বিদেশিরা আশানুরূপ লাভবান হচ্ছে বিধায় তারা বৈদেশিক বিনিয়োগে আগ্রহ পাচ্ছে।

বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে দেশে কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা অগ্রাধিকার দেয় উন্নত প্রযুক্তিকে বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে সরকার। রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অনেক কমে গেছে। দেশের রাজনীতিতে বইছে শান্তির সুবাতাস যা বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময়।

বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে পর্যাপ্ত পুঁজির সঙ্গে দক্ষ ব্যবস্থাপকেরও আগমন ঘটে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সম্ভাবনাময় একটি দিক। বৈদেশিক বিনিয়োগে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় যা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। তাছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নত অর্থনীতি ও দক্ষতা সম্পন্ন দেশ বিনিয়োগ করে, এতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে একসময় বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বর্তমান সময়ে সরকারি রীতি-নীতি পরিবর্তন করায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পথ সুপ্রশস্ত হয়েছে। বর্তমান সরকার বিনিয়োগে সকল প্রকার হয়রানি প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

বর্তমান সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিদেশিদের কাছে উজ্জ্বল হয়েছে। বাংলাদেশও প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে, এদেশে বর্তমানে উন্নয়ন-বান্ধব, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ বিদ্যমান। সম্ভাবনার দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করা হল। এখন দেখা যাক বর্তমান সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা কী। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশকিছু বিনিয়োগ নীতির সংস্কার করেছে। দেশটিতে বর্তমানে বিনিয়োগ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়ক স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান। ইতোমধ্যেই দেশটি একটি মাঝারি মানের কিন্তু সুষম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

অর্থনৈতিক নীতিসমূহের ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করেছে। এসব ক্ষেত্রে সরকার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে, নিয়ন্ত্রকের নয়। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধকে ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ এবং রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধিত হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক ও আকর্ষণীয় প্রস্তাবসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার যাতে রপ্তানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি ভারি ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় যা দেশীয় আমদানি ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে। এখন সরকার কর্তৃক প্রদেয় কিছু বৈদেশিক বিনিয়োগ সুবিধা লক্ষ্য করিÑ ১০০ ভাগ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ডিএফআই) অথবা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাতে (ইপিজেড) যৌথ বিনিয়োগ অথবা এ এলাকার বাইরের বিনিয়োগ। স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পাবলিক কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের দ্বারা তালিকাভুক্ত বিনিয়োগ। অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ যেমন বিদ্যুৎখাত, তেল, গ্যাস ও খনিজ অনুসন্ধান, টেলিযোগাযোগ, বন্দর, সড়ক ও জনপথ। সরাসরি ক্রয় অথবা সরাসরি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় করা (বেসরকারি প্রক্রিয়াধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার)। বেসরকারি ইপিজেড বিনিয়োগ।

মোদ্দা কথা, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিসহ তাদের আস্থা অর্জনে সফল হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বৈদেশিক বিনিয়োগে কিছু সমস্যা বিদ্যমান। এ সমস্যাগুলো সমাধান হলে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হবে। এবার কিছু সমস্যার ওপর আলোকপাত করা যাক। বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, অদক্ষ শ্রমিক, বাজারের সংকীর্ণতা, শ্রমিক অসন্তোষ, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল নিত্য অনুষঙ্গ। হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, ভাঙচুর, কারখানায় অগ্নিসংযোগ বাংলাদেশের স্বাভাবিক ঘটনা। এতে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর প্রদেয় প্রস্তাব বিবেচনা করতে সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করে, ফলে বিনিয়োগকারী বিরক্ত হয়ে অনেক সময় এদেশের পরিবর্তে অন্য কোন দেশে চলে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাব বিবেচনার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায় না। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া যানজট, বন্দরে জাহাজীকরণে প্রচুর সময় ক্ষেপণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও শিক্ষার নিম্নমানের কারণে এখানে শ্রমশক্তি অদক্ষ থেকে যায়। অদক্ষতার কারণে অনেকে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় না।

বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশ হলেও এদের বেশিরভাগের কোনো ক্রয়ক্ষমতা নেই, ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম যা বিনিয়োগকারীকে নিরুৎসাহিত করে। যার ফলে বিনিয়োগ কম হয়। শ্রমিক অসন্তোষ বাংলাদেশে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সামান্য বিষয়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের সর্বত্র দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সমস্যা। সরকারি পর্যায়ে কোনো কাজ দুর্নীতি ছাড়া আশা করা যায় না। পাশাপাশি সুশাসনের অভাবও বাংলাদেশের একটি সমস্যা। ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি এদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেক সময় বিদেশিরাও এসবের শিকার হয়। এসব কারণেও বিনিয়োগকারীরা এদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয় না।

উল্লিখিত বিদ্যমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হলে এদেশ সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগ-বান্ধব দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। আজ বিশ্বের বিনিয়োগকারী দেশগুলো যখন চীন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে অন্য দেশে বিনিয়োগ করার পথে ধাবমান, তখন আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে সহজেই বিনিয়োগ-বান্ধব দেশ হিসেবে বিশ্বে সুদৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি করতে পারি। আশা করি আমাদের সরকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে এ ব্যাপারে সঠিক ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

 

প্রণব রায় : কলাম লেখক

 
Electronic Paper