চীন-ভারত দ্বৈরথ : কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ
সাইফুল ইসলাম হাফিজ
🕐 ৭:৫১ অপরাহ্ণ, জুন ২৫, ২০২০
চীন-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। দু’দেশের সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে পাল্টাতে শুরু করেছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক চিত্র। ভারত শুধু চীনের সঙ্গে নয় সীমান্তবর্তী দেশ পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গেও শীতল সম্পর্ক পার করছে। চীন-ভারত দ্বন্দ্বে ভারতের চির বৈরী দেশ পাকিস্তান চীনকে সমর্থন দিয়েছে।
ভারতীয়দের দাবি নেপালের হঠাৎ ভারত বিরোধী কর্মকা-ের পেছনেও কলকাঠি নাড়ছে চীন। এই সংকটময় মুহূর্তে বাংলাদেশকে উভয় দেশই কাছে টানার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীন-ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সালে মালদ্বীপের নির্বাচন এবং ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দিলে খুব সহজেই চীন-ভারত রেষারেষির কারণ আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশকে নিয়েও এমনটা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। যার প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বেইজিং ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। চীনের বাজারে নতুন করে বাংলাদেশের ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে চীন।
আগামী ১ জুলাই থেকে যা কর্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। গত ১৬ জুন চীনের ট্যারিফ কমিশন এ তথ্য জানায়। আচমকা বাংলাদেশকে খুব কাছে টেনে নেওয়ার কারণটা আপাতদৃষ্টিতে ধোঁয়াশাপূর্ণ মনে হলেও আসলে বেশ স্পষ্ট। বাণিজ্যক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যাতে চীনমুখী হয়ে পড়ে এবং চীন-ভারত ইস্যুতে বাংলাদেশ চীনকে পুরোপুরি সমর্থন না করলেও বিরুদ্ধে যেন মুখ না খোলে সেজন্য এই সুবিধা দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে চীন! দু’দেশই কাছে টানলে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে? বস্তুত, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে একটি নীতিই অনুসরণ হয়ে আসছে। সেটি হলো ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’।
স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান যখন নতুন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন তখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ পুঁজিবাদ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ও সমাজতন্ত্র (সোভিয়েত রাশিয়া) দুটি ব্লকে বিভক্ত ছিল। তিনি কোনোটিতেই যোগ দেননি। তিনি নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রদর্শিত পথেই হাঁটতে হবে বাংলাদেশকে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সকলের সঙ্গেই সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী নতুন কিছু নয়; এ সম্পর্ক প্রাচীন। দুই হাজার বছর কিংবা তারও বেশি আগের সম্পর্ক। কিন্তু ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে চীনের সমর্থন বাংলাদেশ পায়নি। তবুও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পরে চীনবিদ্বেষী কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। চীন শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে (নমিনাল জিডিপি) বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি।
প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তাতে খুব অল্প দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে প্রথম স্থান দখলের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। শুধু বাংলাদেশ নয় বিরোধপূর্ণ দেশ ভারতের বাজারও চীনা পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনার অংশীদার বাংলাদেশও। এই বৃহৎ ভূ-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীনের যেমন অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে তেমন বাংলাদেশও লাভবান হবে। অপরদিকে, ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র। বাংলাদেশের তিন দিক দিয়ে সীমান্ত সম্পর্ক আছে ভারতের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম।
ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সামরিক সহযোগিতার কারণে পাকিস্তানের বৈষম্য ও নিষ্পেষণমূলক শাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করছি। যদিও ভারতের কিছু স্বার্থ ছিল কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ভারতের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান। ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে কৃষিপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ জিনিসপত্রই দু’দেশের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি হয়ে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে কিছু বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় সেগুলো উভয়ের জোরাল কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অটুট রাখতে অতীতে বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।
সব মিলিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারত উভয়েরই সম্পর্ক বেশ চমৎকার। কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে একমুখী নীতি অবলম্বন করা বাংলাদেশের উচিত হবে না। অর্থাৎ, পূর্ণ চীনমুখীও হওয়া যাবে না। আবার, একেবারে ভারতনির্ভর হলেও চলবে না। সুখে-দুঃখে ভারতের পাশে থাকতে হবে এবং চীন বিরোধীও কোনো নীতি গ্রহণ করা যাবে না। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের যুগে একটি উন্নয়নশীল দেশের শুধু ভূ-রাজনৈতিক কারণে কোনো উন্নত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল করলে তা হবে আত্মঘাতী। ভারত-চীন, ভারত-নেপাল এবং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যে দিকেই গড়াক না কেন আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি পরিবর্তন করে কোনো পক্ষে যোগ দেওয়া যাবে না।
ভারতকে সমর্থন দিলে চীনের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হবে; চীনকে সমর্থন দিলে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী টিকবে না। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে দেখা দিবে ভীষণ অস্থিরতা। যেমনটা ঘটেছিল মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়। সুতরাং আমাদের চিরসুন্দর পররাষ্ট্র নীতিতেই অবিচল থাকতে হবে। সব দেশের সঙ্গেই সমান সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উভয়ের সমর্থন পাবে এবং স্বাবলম্বীও হতে পারবে। এশিয়ার দুই প্রধান শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাংলাদেশের দরকার হবে বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি। তবেই বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারবে।