‘সামাজিক দূরত্ব’ কতটা যৌক্তিক
মো. মুনিরুজ্জামান
🕐 ৭:১২ অপরাহ্ণ, জুন ২৪, ২০২০
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ কথাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশেষজ্ঞরা করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত যে কোনো আলোচনায় সর্বত্র কথাটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে।
যেহেতু করোনাভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়ায়, তাই করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জনসমাগম এবং ভিড় এড়িয়ে যথাসম্ভব ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে সংক্রমণ রোধে ৩ ফুট বা ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, জনসমাগম বা ভিড় এড়িয়ে চলা কিংবা ৩ ফুট বা ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা কি ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’? নাকি ‘শারীরিক দূরত্ব’ বা ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং? এককথায় কোনো উপসংহারে না পৌঁছে বিষয়টি একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সমাজে বসবাস করে বলেই মানুষ সামাজিক জীব।
তাই, সামাজিক জীব হিসেবে সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে অথবা যে কোনো প্রতিকূলতা বা দুর্যোগেও মানুষ এই সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখতে চায়। আর এই একবিংশ শতাব্দীতে শারীরিকভাবে অনেক দূরে থেকেও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। জনসমাগম সৃষ্টি করতে না পারা, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক কর্মকা- ঠিকভাবে করতে না পারা, আত্মীয়স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে না গিয়ে নিজের বাড়িতে থাকা কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সশরীরে যেতে না পারলে হয়ত কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তবে পরস্পরের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক অটুট রাখা সম্ভব। এখন তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় খুব সহজে যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক, দাফতরিক এবং শিক্ষা কার্যক্রম, যে কোনো আলোচনা সভা কিংবা মিটিং, ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে।
এমনকি বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানও ঘরে থেকেই ভার্চুয়ালি করা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ) তাদের প্রায় সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অংশগ্রহণে গত রমজানে ভার্চুয়াল ইফতার ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। এমন হয়ত আরো অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ঘরে বসেই ভার্চুয়ালি সম্পন্ন করছে। অর্থাৎ যে কোন ভার্চুয়াল সোশ্যাল গ্যাদারিং এখন অত্যন্ত সহজসাধ্য একটি ব্যাপার। সুতরাং, শারীরিকভাবে দূরে থাকা মানেই সামাজিক দূরত্ব নয় তা স্পষ্টত প্রতীয়মান।
আবার বিশেষজ্ঞরা এমন পরামর্শও দিয়ে থাকেন, মহামারি চলাকালে যারা হোম কোয়ারান্টিন বা আইসোলেশনে থাকবেন তারা যেন বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় তাদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, সহপাঠী বা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এতে তাদের মনোবল বাড়বে, ডিপ্রেশন দূর হবে এবং তারা মানসিকভাবে অনেক ভালো থাকবেন। তাই কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নয়, বরং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সবার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি।
এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক আগেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ -এর পরিবর্তে ‘শারীরিক দূরত্ব’বা ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ কথাটি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, সংক্রমণ রোধে শারীরিকভাবে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। মানুষ চাইলেই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সবার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে (সোর্স : গ্লোবাল নিউজ, সাইন্স এলার্ট, উইকিপিডিয়া)।
Massachusetts Congresswoman Ayanna Pressley বলেন, ‘আমরা বর্তমানে যেটি করছি এটি ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ নয়। আমরা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখছি। এই অবস্থায় আমাদের সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। (সোর্স : সাইন্স এলার্ট ওয়েবসাইট)।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক জামিল জাকি বলেন, ‘আমাদের সকল আলোচনায় ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ কথাটি পরিহার করা উচিত। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কিভাবে সামাজিক সম্পর্ক অটুট রাখা যায় আমাদের সেই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। তিনি ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ -এর পরিবর্তে ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ বা ‘ডিসট্যান্ট সোশ্যালাইজিং’ কথাটি ব্যবহারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। (সোর্স : সাইন্স এলার্ট ওয়েবসাইট এবং স্ট্যানফোর্ড ওয়েবসাইট)।
এই ব্যাপারে Northwestern University-Gi Asset-based Community Development Institute (ABCD) ফ্যাকাল্টি মেম্বার Cormac Russell বলেন, এই সময়ে আমাদের ঘরে থাকতে হবে এবং কোনো প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু এই সময় ভালো থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার কার্যকরী উপায় খুঁজতে হবে (সোর্স : Quartz/qz.com)। বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয়, করোনা প্রতিরোধে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ নয় বরং ‘শারীরিক দূরত্ব’ বা ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ বজায় রাখা জরুরি। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সাধ্যমতো ‘সামাজিক সম্পর্ক’ বা ‘সোশ্যাল কানেকশন’ বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত।
মো. মুনিরুজ্জামান : প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়