ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কামাল লোহানী : বিদায়ের বারবেলা...

মৃত্তিকা দেবনাথ
🕐 ৭:০৪ অপরাহ্ণ, জুন ২৪, ২০২০

কোনো এক শনিবারে কামাল লোহানীর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। তারপর থেকে আমি অসুস্থ হওয়ায়, তিনিও অসুস্থ থাকায় সেই শনিবার আর আসেনি। পরে শনিবার এল তার বিদায়ের বারবেলা হয়ে। না ফেরার দেশে চলে গেলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। পরিচয়ের পর থেকে তাকে দাদুই ডাকতাম। কামাল লোহানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, ভাষাসৈনিক, বিশিষ্ট সাংবাদিক। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন।

হাসপাতালে যাওয়ার কয়েক দিন আগেও মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল, পৃথিবীর অসুখ সেরে গেলে ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস’-এর খসড়া পান্ডুলিপি রচনার জন্য বসবেন তিনি। তার চলে যাওয়ার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। অসাম্প্রদায়িকতার কথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলার মানুষটি চলে গেলেন, চলে গেলেন ছায়া দেওয়ার বটবৃক্ষটি। শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কামাল লোহানী কয়েক দশক ধরে আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা জগতে সক্রিয় ছিলেন। ছোটবেলায় বাবা-দাদাদের মুখে শুনেছিলাম কামাল লোহানীর নাম। তার প্রকৃত নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী।

জীবনের শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ সক্রিয়। ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রনাথ বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তার পাঁচ বছরের মাথায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। ষাটের দশকের শেষ দিকে যোগ দেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপে এবং সক্রিয় হন আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে। ওই সময় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে শিল্পীদের সংগঠিত করার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

১৯৭১ সালে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান। দীর্ঘ পেশাগত জীবন ছিল সাংবাদিকতায়। কাজের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোতেও। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে একুশে পদক পান। ছায়ানট ছাড়াও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘকালের।

খুলনার নিভৃত গ্রামে বাস করায় তার সঙ্গে কখনোই সাক্ষাৎ হয়নি আমার। প্রথম দেখার সুযোগ এল বিয়ের পর। একদিন আমার স্বামী হিরণ্ময় হিমাংশু জানালেন পাণ্ডুলিপির প্রুফ দেখানোর জন্য কামাল লোহানীর বাসায় যাচ্ছেন। আমিও যেতে চাইলে কল দিয়ে অনুমতি নিলেন কামাল লোহানীর। উনি ওপাশ থেকে বললেন, ‘আচ্ছা, এসো’।

প্রথম কামাল লোহানী দাদুর বাসায় যাওয়া। বাসার দরজা খুললেন লোহানী দাদুর বড় মেয়ে বন্যা পিসি, বললেন, ‘এসো’। ড্রয়িংরুমে বসার ২ মিনিটের মধ্যে লোহানী দাদু এলেন। উনি আসতেই আমরা দুজন উঠে দাঁড়িয়েছি। তখন আমার মধ্যে একটি অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। এই মানুষটিই তবে কামাল লোহানী! তার চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলাম। উনি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন ‘বেঁচে থাকো’।

তার পরপরই আমার স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন ‘কে এই নববধূ, হিরণ্ময়?’

তিনি বললেন, আমার সহধর্মিণী, আপনাকে প্রণাম করতে এসেছে। সে ভালো গান করে।

তখন লোহানী দাদু বললেন, তবে নাতবউয়ের গান শুনব, আগে নাস্তা খেয়ে নাও।

তারপর নাস্তা খেতে খেতে কথা শুরু হল তার বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে। এর আগে শুদ্ধপ্রকাশ-এর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থমালায় প্রকাশ করেছি তার স্মৃতিকথা ‘কিশোরবেলা;। বইমেলা ২০১৯-এ। তার আগেই তিনি আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন, তারই কিছু অংশ নিয়ে আমরা ‘কিশোরবেলা’ প্রকাশ করি। অখ- আত্মজীবনী প্রকাশিত হবে আরেকটি প্রকাশনী থেকে। সেটি প্রায় স্থির করেছিলেন তিনি। তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসায় আরেকজনের সাহায্যে লেখার কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানিয়েছিলেন তার আত্মজীবনী লেখার কাজটা প্রায় শেষ হলে শুদ্ধপ্রকাশকের জন্য ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস’ লেখায় হাত দেবেন। যেহেতু দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে তাই লেখার কাজে আমরাই সাহায্য করব।

দাদুর মুখে শুনলাম, প্রায়ই তার ছোট মেয়ের বাসা থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার আসে তার জন্য। সঙ্গে তার প্রিয় লাউয়ের পায়েস থাকবেই। সেদিনও আমরা খেয়েছিলাম দুধ দিয়ে কচি লাউয়ের পায়েস, পাঁপড়, ফুলি পিঠা, নিমকি, চানাচুরসহ অনেক কিছু। সেই কচি লাউয়ের পায়েস যেন অমৃত। উনি তখন তেমন কিছু খান না। চিকিৎসকের বারণ। শুধু লাউয়ের পায়েস খাচ্ছিলেন, খেতে খেতেই আমার সম্পর্কে জেনে নিলেন, শুনলেন বাবার বাড়ি, ভাইবোনদের কথা। দাদু গান শুনবেন কিন্তু বাসার হারমোনিয়াম যেন কার বাসায় আছে, সেটা বলতে একটু সংকোচ করছিলেন বন্যা পিসি। বললাম, হারমোনিয়াম দরকার নেই। খালি গলায় গাইতে পারব। গান শেখার শুরুতে হারমোনিয়াম ছাড়া গান গাওয়ার অভ্যাস ছিল। জানতে চাইলাম, কী গান শুনবেন দাদু?

উনি বলেন নজরুল গীতি। তখন আমি নজরুল গীতি গাইলাম ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়...’। চোখ বন্ধ করে সেই গান মনপ্রাণ দিয়ে শুনলেন। গান শেষ হতেই বললেন, ‘চমৎকার। এত চমৎকার গান আগে কখনোই শুনিনি খালি গলায়।’

তারপর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলাম, ‘এই কথাটি মনে রেখো আমি যে গান গেয়েছিলাম...’।

লোহানী দাদু মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘গান শুনে খুব সন্তুষ্ট হয়েছি নাতবউ। তোমার গান আমার মনকে স্পর্শ করেছে। কারণ তুমি শুদ্ধ সঙ্গীতচর্চা করো সে জন্য। আর এখন শুদ্ধ সঙ্গীতচর্চা তেমন হয় না। কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেলে গান শুনে মন ভরে না। কী যে সব গায় এখন ঠিক বুঝতে পারি না। তোমরা কোনো এক শনিবার বাসায় এসো। সারাদিন গান শুনব আর গল্প করব তোমাদের সঙ্গে।’

আমি হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় ও তার শারীরিক জটিলতার জন্য জীবনে সেই শনিবার আর এল না। যখন শনিবার এল, তা তার বিদায়ের বারবেলা হয়ে। শনিবারেই দাদু চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কী বেদনাদায়ক সেই শনিবার যখন আজকের শনিবারে এসে মিলেছে। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে খুব। তাকে আর গান শোনাতে না পারার কষ্টে দু’চোখ গড়িয়ে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট-বেদনা রাখার জায়গা নেই। শনিবার গান না শোনাতে পারার অপরাধ মন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে এখন। আর এমনই ভাগ্য শনির দশায় পুরো পৃথিবী, শেষ দেখারও উপায় নেই আজ। আমি খুলনাতে, চারপাশে করোনাভাইরাস ঘিরে রেখেছে।

২০১৯-এর বইমেলায় আমাদের শুদ্ধপ্রকাশ-এর স্টলে এসেছিলেন লোহানী দাদু, স্টলের কাছে এগিয়ে আসতেই কমবয়সী (৮ বছর) লেখক অমর্ত্য রূপাই তার সামনে গিয়ে করমর্দন করে বলল, ‘আমি শুদ্ধপ্রকাশের সব থেকে ক্ষুদে লেখক।’

সঙ্গে সঙ্গে লোহানী দাদু বলে উঠলেন, ‘আমি সব থেকে প্রবীণ লেখক শুদ্ধপ্রকাশের!’

দুজনের পরিচয় পর্ব দেখে সবাই পুলকিত হলাম। নবীন-প্রবীণের কথোপকথনে স্টলের আশপাশের সবাই উৎসাহিত হল। তারপর স্টলের সামনে ছবি তুললেন প্রবীণ লেখক ও ক্ষুদে লেখক। আমাদের প্রকাশিত আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থগুলো দেখে খুব খুশি হলেন। তার লেখা ‘কিশোরবেলা’ হাতে নিয়ে বললেন, ‘বইটি খুব ভালো হয়েছে। প্রচ্ছদটি খুব সুন্দর।’

কামাল লোহানীর মতো ব্যক্তিরা ছিলেন বলেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান হয়েছিল। ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের জন্যও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন কখনো পথ হারায়নি এ ধরনের মানুষের শক্ত উপস্থিতির কারণে। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যে অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন তা সবসময়ই নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সেবায় নিজের পুরো শরীর দান করেছেন তিনি। কিন্তু করোনার জন্য সেই আশা অপূর্ণই রইল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার কণ্ঠেই তো দেশবাসী শুনেছিল, ‘আমরা বিজয় অর্জন করেছি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।’ সমকালীন শাসনব্যবস্থা, রাজনীতি নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল যথেষ্ট। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আপসহীন এই যোদ্ধাকে আমরা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করতে পারিনি, অথচ স্বাধীনতার জন্য যার অবদান অপরিসীম। যদিও এসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সমকালীন ইতিহাস মানে ক্ষমতাশালীর ইতিহাস, এই ইতিহাস যেমন করেই লেখা হোক, আগামী হাজার হাজার বছরের সত্যিকার ইতিহাস হল জনস্মৃতি বা জনশ্রুতি, অসাম্প্রদায়িক বাংলার মানুষ সেই জনশ্রুতিতে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে। সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করবেন দূর আকাশের তারা কামাল লোহানী। শোকাহত প্রাণের শ্রদ্ধাঞ্জলি!

 

মৃত্তিকা দেবনাথ : সঙ্গীত শিল্পী

[email protected]

 
Electronic Paper