মাসুদ রানাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি!
সত্যজিৎ বিশ্বাস
🕐 ৭:৪৬ অপরাহ্ণ, জুন ২৩, ২০২০
১৯৬৬ সালে প্রথম মাসুদ রানা আসে ‘ধ্বংস পাহাড়’ নিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেনের কলমের ছোঁয়ায় বাংলার প্রথম স্পাই থ্রিলারধর্মী সুপার হিরো চরিত্র মাসুদ রানা এল পাঠকের হাতে। এ যেন জেমস বন্ডের বাঙালি সংস্করণ। মাসুদ রানা পড়ে পাঠক পরিচিত হলো সারা বিশ্বের সঙ্গে। এক একজন পাঠক মনে মনে হয়ে উঠল, এক একজন অকুতোভয় মাসুদ রানা।
`মাসুদ রানা, তুমি কার?
কে জিতবে, কার হবে হার?’
আচমকা এক বজ্রপাতে কেঁপে উঠল সারা দেশ। সেই বজ্রপাত বিনা মেঘে নাকি বহুদিনের জমে থাকা মেঘের ঘনঘটায় সেটা অবশ্য এখনও পরিষ্কার না। সাময়িক দুর্বোধ্য প্রশ্নের উত্তর সবসময় ‘সময়’ দিয়েছে। আস্থা রাখি, এবারও সময়ই সে প্রশ্নের উত্তর দেবে।
অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম দুটি বই কাজী আনোয়ার হোসেনের মৌলিক লেখা। পরবর্তীকালে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয় মাসুদ রানা। তিনি মাসুদ রানাকে শুধু দুর্র্ধর্ষ গোয়েন্দা হিসেবেই পাঠকদের সামনে আনেননি, এনেছেন প্রতিটি পাঠকের স্বপ্নের নায়ক করে। সহায়ক চরিত্র হিসেবে মাসুদ রানার বস মেজর জেনারেল রাহাত খান এসেছেন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান হিসেবে। স্বাধীনতার আগের বইগুলোতে সংস্থাটির নাম উল্লেখ থাকত পিসিআই (পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সি)।
সহকর্মী ও বন্ধু চরিত্রে এসেছে সোহেল, সলিল, সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া। এই এক একটা চরিত্র যেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ জ্বলজ্বল করা পাঠকের মনের আকাশের তারা। বন্ধু সোহেলের ফাজলামি, গিলটি মিয়ার মজার মজার কর্মকা-ের মাঝেই ভয়ঙ্কর সব মিশনে নামে মাসুদ রানা। মাসুদ রানার চিরশত্রু বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী কিংবা উ সেন যেন প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করেই থাকে মাসুদ রানাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য। এত সব থ্রিলের মাঝেও মাসুদ রানার অন্তরে জায়গা করে নেয় সোহানা। সোহানা লেখকের ভাবনায় আসা শতভাগ খাঁটি বাঙালি মেয়ে, মাসুদ রানার ভালোবাসা। এই সোহানার প্রেমে পড়েনি, এমন একজন পাঠক কিংবা সোহানাকে ঈর্ষা করেনি এমন একজন পাঠিকা কি গত তিন প্রজন্মে পাওয়া যাবে?
কিন্তু তাতে কী? জনতার মনে এখন কোটি টাকার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। ‘জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানা’র পিতা কে? কার জিন টেস্ট করে পাওয়া যাবে মাসুদ রানার মূল জনকের পরিচয়?
যাকে নিয়ে এত কথা, খোঁজা শুরু করে দিলাম সেই মাসুদ রানাকেই। কোথায় সেই বিতর্ক সৃষ্টিকারী কালপ্রিট? চোখ দুটো বড় বড় করে এখানে-ওখানে হাজার খুঁজেও যাকে পেলাম না, তাকে নিমিষেই পেয়ে গেলাম ক্লান্ত হয়ে চোখ দুটো বুজে আসার পর।
এই যে মাসুদ রানা, কোথায় ছিলেন?
এই সময়ে কোথায় আর থাকব? বুক সেলফে আরো অনেকের সঙ্গে হোম কোয়ারান্টিনেই তো আছি।
আপনাকে নিয়ে এখন কী হচ্ছে জানেন?
মাসুদ রানা’ নামে একটা সিনেমা হওয়ার কথা শুনেছিলাম। হয়ে গেছে ওটা?
ওটা না হলেও আপনাকে নিয়ে ‘বাবা কে’ নামে লাইভ সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। সত্যি করে বলবেন, আপনি আসলে কার?
কোনো সৃষ্টি কি বলতে পারে, সে আসলে কার সৃষ্টি?
তাও তো কথা। তাহলে জানব কী করে?
কাজী আনোয়ার হোসেন আর শেখ আবদুল হাকিমকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। আমার স্রষ্টাই জানে, আমি কার কে আমার।
ঠিক আছে, যাচ্ছি তবে।
ঠক ঠক ঠক। কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব বাড়ি আছেন? ‘মাসুদ রানা আসলে কার’ বলবেন কি?
কাজী আনোয়ার হোসেন : মাসুদ রানা তো অ্যাডাপটেশন। এটার মূল লেখা আমার না, লেখক প্যানেলেরও না। মাসুদ রানা চরিত্রটি আমার সৃষ্টি। তাতে রাহাত খান, সোহেল, সোহানা নামের যে জনপ্রিয় চরিত্রগুলো আছে, একটা বিশেষ ঢঙে আমিই তা সৃষ্টি করেছি। কিন্তু একটা সময়ে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না, শেখ আবদুল হাকিমকে ডেকে বললাম আপনি লিখতে চান এটা? আমার সব শর্ত মেনে শেখ আবদুল হাকিম রাজি হলেন এবং টানা ৪৫ বছর ধরে লিখলেন। এগুলো লিখে আনার পর টাকা দিয়ে দিয়েছি। তারপর আবার সেটা সম্পাদনা করে ছাপার উপযোগী করেছি।
কাজী আনোয়ার হোসেন নিজের ঢোল নিজে পেটাতেই পারেন। এক পক্ষের কথা শুনে কখনোই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তাছাড়া উনি অনেক টাকাওয়ালা লোক। বড়লোকদের মন বড় হয়, এ কথা কে শুনেছে কবে? এবার তাহলে যাওয়া যাক শেখ আবদুল হাকিমের কাছে।
ঠক ঠক ঠক। শেখ আবদুল হাকিম সাহেব বাড়ি আছেন? ‘মাসুদ রানা আসলে কার’, যদি বলতেন?
শেখ আবদুল হাকিম : যখন লেখা শুরু করলাম, তখন আমার বয়স ১৮ বছর। কপিরাইট বিষয়টি বুঝতাম না। আইন জানতাম না। তখন আমার টাকার প্রয়োজন ছিল, টাকা পেয়েছি, লিখেছি। তিনি রয়্যালিটি দিয়েছেন, কিন্তু যা প্রাপ্য তা দেননি। আমি তো প্রাপ্য টাকার জন্য আইনের আশ্রয় নিতেই পারি। কী, পারি না?
কী আশ্চর্য, শেখ আবদুল হাকিম একবারও মাসুদ রানা আমার বলে দাবি করলেন না! ‘কেন দাবি করছেন না’ প্রশ্নটা করতে যাওয়ার আগেই বন্ধ হওয়া চোখ দুটো গেল খুলে।
তাতে কী, উনি দাবি না করলে কী উৎসুক জনতা দাবিত্ব ছেড়ে দেবে? তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি, অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুকে তোলা ঝড়ের কি কোনো দাম নেই? শেখ আবদুল হাকিম বা অন্য কেউ দাবি করুন বা নাই করুন মাসুদ রানা পয়দার দাবিত্ব জোর করে হলেও যে কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে তাদের ছিনিয়ে আনা চাই।
প্রসঙ্গক্রমে ‘জোর’ নিয়ে একটা ন্যানো গল্প মনে পড়ে গেল। এক নেতা তার চ্যালাদের বোঝাচ্ছিলেন ‘জোর’ জিনিসটার আসলে কত জোর আছে। বোঝানোর এক পর্যায়ে নেতা বললেন, তোদের হাতে যখন ক্ষমতার জোর থাকবে তখন সেই জোর দিয়ে আইনের গালে ঠাস করে থাপ্পড় দিবি।
সবাই তোদের সমঝে চলবে। এক চ্যালা বলে উঠল, যদি ক্ষমতার জোর না থাকে? নেতা বললেন, যদি ক্ষমতার জোর না থাকে, তখন তোরা গায়ের জোরে আইনের গালে থাপ্পড় দিবি। পেছন থেকে এক রোগা পটকা চেহারার চ্যালা মাথা চুলকে বলল, নেতা, সবার কি আর গায়ের জোর থাকে? নেতা হাসতে হাসতে বললেন, এরও উপায় আছে। যখন গায়ের জোরও থাকবে না, তখন চাপার জোর দিয়ে ঘায়েল করতে হবে। তবু জোর কমানো যাবে না। কাজী আনোয়ার হোসেন ও সেবা প্রকাশনীকে নিয়ে যারা চাপার জোর চালাচ্ছেন, তারা একবার অতীত ঘেটে দেখবেন কি, মাসুদ রানা আসলে কার? কেন।
জানার খুব ইচ্ছে ছিল যে।
সত্যজিৎ বিশ্বাস : রম্য লেখক