লিবিয়া ট্রাজেডি ও অবৈধ অভিবাসন
সাহাদাৎ রানা
🕐 ৭:৩২ অপরাহ্ণ, জুন ০৫, ২০২০
সারা বিশ্বেই এখন প্রধান আলোচনার বিষয় করোনাভাইরাস। হওয়াটাও স্বাভাবিক। কেননা, করোনার প্রভাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে সম্প্রতি একটি ঘটনা সবার মনে দাগ কেটেছে বিশেষভাবে।
লিবিয়ায় মিজদা শহরে ত্রিশজন অভিবাসী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশের নাগরিক। এখনও বেশ কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। যারা নিজেদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে জীবনের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন অজানার পথে। এবার সেই অজানার পথেই হারিয়ে গেলেন তারা। কষ্টে থাকা বাবা-মার স্বপ্ন আর সত্যি করা হল না এসব স্বপ্নবাজ যুবকের। বিদেশে পাড়ি জমাতে প্রাণ হারানোর ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়।
এর আগেও অসংখ্যবার অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তবে এবার পাচারকারী সদস্যদের হাতে একসঙ্গে এত লোকের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল। মূলত একজন লিবিয়ায় পাচারকারীকে হত্যার অভিযোগে তার পরিবারের সদস্যরাই এ অভিবাসীদের হত্যা করেছে। ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, প্রথমে বাংলাদেশিসহ ওই অভিবাসীদের মিজদা শহরের একটি জায়গায় টাকার জন্য জিম্মি করে রেখেছিল মানব পাচারকারী চক্র।
নানা বিষয় নিয়ে পাচারকারীদের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন অভিবাসীরা। অভিবাসীদের হাতে এক পাচারকারী মারা যান। এরপর প্রতিশোধ নিতে নিহত পাচারকারীর পরিবারের লোকজন নির্বিচারে গুলি চালায়। যেখানে ৩০ জন মারা যান। এমন ঘটনা সবার মনে আলাদাভাবে দাগ কেটেছে।
বাস্তবতা হল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমায়। অবৈধ পথেও তাদের এর জন্য ব্যয় করতে হয় বিপুল অর্থ। অনেক টাকা খরচ করলেও হাতে থাকে না কোনো বৈধ কাগজপত্র। বিভিন্ন উন্নত দেশে যাওয়ার জন্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি টার্গেট থাকে লিবিয়া। তবে লিবিয়ায় থাকার উদ্দেশ্যে নয়। বর্তমানে এমনিতে লিবিয়াতে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত।
অথচ সেখানেই অবৈধ পথে যাচ্ছে যুবকরা। লিবিয়ায় যাওয়ার মূল্য উদ্দেশ্য অবশ্য অন্য। প্রথমে লিবিয়ায় গিয়ে এরপর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়া। এমন কর্মকা- অনেক বছর ধরেই চলছে। মাঝে মাঝে অনেক অভিবাসীর নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
কিন্তু বিচার না হওয়ায় সব কিছু আবার আড়ালেও চলে যায়। মূলত লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে খুব সহজে ইউরোপের অনেক দেশে যাওয়া যায়। এ কারণে যুবকরা প্রথমে লিবিয়ায় যেতে চান। এবারও যারা নিহত হয়েছেন তারাও লিবিয়ায় গিয়েছিলেন এর জন্য। লিবিয়ায় যাওয়া সহজ হওয়ায় পাচারকারীদের সাহায্যে এ সুযোগটাই নেয় কিছু স্বপ্নবাজ যুবক। এমন কঠিন সুযোগ নেয় মূলত দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের স্বল্পশিক্ষিত বেকার তরুণরা। কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে মূলত এ পথ বেছে নেন তারা। তবে সবাই নয়, অনেকের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন কাজ করে এক্ষেত্রে। দেশে কিছু না করে বিদেশে কিছু করার বিষয়ে কেউ কেউ মনোযোগী। এখানে অস্বস্তির তথ্য হল, অবৈধভাবে হলেও সামান্য অর্থ নয়, বরং বিপুল অর্থ জোগাড় করতে হয় তাদের।
এসব যুবকের পরিবার ধারদেনা করে কয়েক লাখ টাকা জোগাড় করে দেয় দালালদের হাতে। অনেক পরিবার টাকা জোগার করতে বাড়ি-ঘর বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। তারপরও স্বপ্ন নিয়ে টাকা জোগাড় করেন। এরপর যুবকরা নিদারুণ কষ্টে অবৈধ পথে তারা পাড়ি জমান অজানার উদ্দেশ্যে। দালালরা নিজেদের কার্য হাসিল করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করলেও ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না এসব যুবকদের। মাঝে মাঝে লাশ হয়ে ফিরে আসতে হয় দেশে।
কোনোভাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেলেও সেখানেও নেই শান্তি। অবৈধ হওয়ায় লুকিয়ে কাজ করতে হয়। সারাক্ষণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ার ভয় কাজ করে। অবৈধ হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ে ধরা পড়ে যান তারা। অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে গিয়ে বর্তমানে অসংখ্য যুবক কারাগারে বন্দি রয়েছেন। আইনি ঝামেলার কারণে যারা পারছেন না মুক্তি পেতে। কারাগারে কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।
অবৈধ অভিবাসন এখন আমাদের জন্য বড় একটি সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কেন না প্রতি বছরই অনিশ্চিত যাত্রা জেনেও হাজার হাজার যুবক এ পথ বেছে নেয়। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। মূলত কর্মসংস্থান সমস্যা অন্যতম কারণ এর পেছনে। বিপরীতে উন্নত বিশ্বে সস্তা শ্রমের চাহিদাও ব্যাপক ভূমিকা রাখে এক্ষেত্রে। দেখা যায় সেখানে গেলে অতিরিক্ত বেতন পাওয়া যাবে এমন লক্ষ্য থাকে সবার।
এক্ষেত্রে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করার স্বপ্ন থাকে সবার মধ্যে। কিন্তু অবৈধ পথে তা সম্ভব নয়। এখন বৈধভাবে অসংখ্য মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে এর জন্য নিজেদের দক্ষ শ্রমিক হতে হবে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। এখানে সবার আগে প্রয়োজন সবার সচেতনতা। মানব পাচাকারীর প্রলোভনে কেউ যেন না পড়ে বিশেষ করে অবৈধ পথে গমন থেকে বিরত থাকে এসব বিষয়কে সামনে রেখে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করে তুলতে হবে।
এক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে। কেননা, বিশে^র সব রাষ্ট্রেই দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক। দক্ষ শ্রমিক হলে বৈধ পথে জনসম্পদ রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে দিন দিন এর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই নিজেদের দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে হবে। এতে নিজে যেমন লাভবান হবেন তেমনি উপকৃত হবে রাষ্ট্র।
পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে নিজের দেশে কিছু করার মানসিকতাও সৃষ্টি করতে হবে যুবকদের। এক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষ করে কৃষি, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুনভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে কৃষিতে আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব। যদি এক্ষেত্রে বেকার যুবকদের আরও বেশি করে কাজে লাগানো সম্ভব হয় তবে দেশের কৃষি অর্থনীতির জন্য হবে ইতিবাচক খবর। তবে এখানে কিছু আশার খবরও রয়েছে। এখন শিক্ষিত যুবকরা কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এতে যেমন তার ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি দেশের অর্থনীতিও হচ্ছে সমৃদ্ধ। তবে এক্ষেত্রে আরও বেশি করে বেকার যুবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে উপকৃত হবেন সবাই।
ইতোমধ্যে মানব পাচারকারী কয়েকজন সদস্য আটক হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এখন এ ধরনের নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনা রোধে উদ্যোগী হতে হবে। সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। মূলত মানবপাচার করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই দেশের কিছু পাচারকারী জড়িত থাকে।
এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখন এ বিষয়গুলো আমলে নেওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। সবার আগে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যাতে আগামীতে দালালরা আর এমন কাজ করতে সাহস না পায়। তবেই হয়ত রোধ করা সম্ভব হবে অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা।
সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক