ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সুস্থ প্রাণের সুরক্ষিত ধরিত্রী

রহিম আব্দুর রহিম
🕐 ৮:২৫ অপরাহ্ণ, জুন ০৪, ২০২০

প্রকৃতি পরিবেশের সকল ইতিবাচক ফলাফল মনুষ্যসমাজ ভোগ করে, প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ বা ধ্বংস করার জন্য মনুষ্যসমাজই দায়ী। প্রকৃতির জন্য প্রাণ নয়, প্রাণ ও প্রাণীর জন্যই প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণের মহামিলনই পরিবেশ। মাটি-পানি, বৃক্ষ, আলো-বাতাস নিয়ে ভূ-ম-লের প্রাকৃতিক পরিবেশ।

প্রকৃতির সকল সুযোগ বিনামূল্যে গ্রহণ করে পৃথিবীর প্রাণিকুল। পরিবেশের নদী-নালা, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, বন-বাদর, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গের যে বাঁধন তা নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা রাখে, একমাত্র মানবকুল। প্রকৃতির সবচেয়ে বড় উপাদান মাটি। মাটিকেই কেন্দ্র করে পৃথিবীর সকল কিছুরই সৃষ্টি। মা সন্তানের গর্ভধারিণী, পৃথিবীর ভূভাগের মাটি সকল প্রাণের গর্ভধারিণী। ফুল-ফসল, খাবার-দাবার, ফল-ফলাদি, জন্ম-মৃত্যু সবকিছুই মাটিকে ঘিরে। ‘মা-মাটি-মানুষ’তিনটি শব্দই পারস্পরিক এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কিত।

শ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়ার বড় মন্ত্র প্রকৃতি-পরিবেশ এবং ধরিত্রী রক্ষা। এ ব্যাপারে আজ থেকে দেড়শ’ বছর আগে, পরিবেশ বিজ্ঞানী ফ্রেডিবিক এঙ্গেলস তার ডায়ালেস্ট্রিক্স অব ন্যাচার গ্রন্থে বলে গেছেন, ‘বৃক্ষ কর্তন, নদীর গতিধারার নির্মম ধ্বংসলীলায় প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। আমরা যদি নির্দয় বিজেতা, বহিরাগত কোনো আক্রমণকারী না হয়ে, প্রকৃতির অনুগত প্রজা হই, তাহলে যে কেবল প্রকৃতি আমাদের আশ্রয়ই দেবে তা নয়, আমাদের রক্ষাকর্তাও হবে। এজন্য প্রয়োজন- প্রকৃতিকে তার মত করে চলতে দেওয়া। অর্থাৎ প্রকৃতির আইন মেনে চলা।’

নদীমাতৃক অঞ্চলের প্রকৃতির ভূষণ, মানবের কল্যাণ ধারায় আমাদের প্রবাহমান নদ-নদী ছিল ৭ শ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। তালিকায় ৪০৫টি থাকলেও, বাস্তবতায় রয়েছে প্রায় ১০০টি। বাকি নদীসমূহ গতিপ্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে। নদ-নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে ইমারত, আবাসন, হাটবাজার, মিল-ফ্যাক্টরি। ফলে, যা হওয়ার তাই হয়েছে।

শুধু ভরাট, আর দখল প্রক্রিয়ায় নদীপথের এ অবস্থা? তা কিন্তু নয়। নজিরবিহীনভাবে নদীদূষণ অব্যাহত থাকায় মানব পরিবেশ আজ ভয়ঙ্কর হুমকির মুখে। অকাল খরা-বন্যা, বহু প্রজাতির স্থলজ-জলজ প্রাণী, মাছ, কীটপতঙ্গের বিলুপ্তি ঘটেই চলছে। বঙ্গবন্ধু সরকারে থাকাকালে এদেশে প্রকৃতি ছিল পরিপূর্ণ। সময়ের ঘূর্ণায়নে তার নেতিবাচক পরিবর্তন দেখে আসছি। বর্তমান সরকার নদীদূষণ রোধ এবং গতিপ্রবাহ সচলে আন্তরিক, দখলমুক্ত করছে নদী, জলাশয়।

শুধু আমাদের দেশই নয়, পৃথিবীর প্রায় নদ-নদী, খাল-বিল, সর্বোপরি সমুদ্র পর্যন্ত দূষণের কবলে পড়েছে। নদীদূষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক ও পলিথিনের বর্জ্য। বর্জ্য এমন আকার ধারণ করেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদী ড্রেজিংয়ের জন্য চীন থেকে আনা শক্তিশালী সাকশন ড্রেজারও ভারি পলিথিনের স্তরে আটকে পড়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্যে, ‘নদীর তলদেশে, মাটির উপরিস্থলে দুই থেকে তিন মিটার পলিথিন স্তর জমা হয়েছে। ড্রেজার মেশিন কাজ করতে পারছে না। ফলে, ১০-১২ ঘণ্টার কাজ; ২৪ ঘণ্টায় শেষ করতে হচ্ছে।‘ পলিথিন আমাদের হাতে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে।

হাট-বাজার, শপিংমলে বেচাকেনা করলেই বিনা পয়সায় পলিথিন ব্যাগ ধরিয়ে দিচ্ছে। যা ব্যবহার শেষে যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছি। এতে আবাদি জমির নিচে কঠিন আস্তর জমছে। ফলে, বৃষ্টির পর মাটি ভেদ করে পানি নিচে যেতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, প্রকৃতি-পরিবেশের। পলিথিন একটি পরিবেশ বিধ্বংসী অক্ষয় পদার্থ। যা তৈরিতে ইথিলিন, পলিকার্বনেট, পলি প্রোপাইলিং ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ বা পলিমারের অনুগুলো পরস্পর এতই সুষ্ঠু ও শক্তভাবে থাকে, যেখানে কোনো অনুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রবেশ করতে পারে না। ব্যাকটেরিয়া, ময়লা-আবর্জনা পচিয়ে ও খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে।

অথচ ব্যাকটেরিয়া পলিথিন নষ্ট করতে পারে না বলে এর মরণ নেই। এ পলিথিন এতই শক্ত যে তার ধ্বংস নেই, বিনাশ নেই, যা পোড়ালে সৃষ্ট গ্যাস হতে কঠিন মনো-অক্সাইড, কঠিন ডাই-অক্সাইডসহ অন্য গ্যাসে বায়ুদূষণ ঘটিয়ে থাকে। এ গ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। পলিথিনে নদীদূষণ, আবাদি জমি ধ্বংস এবং ছত্রাক বাঁচিয়ে রাখতে সহায়ক, ফলে এ পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করণে আইন প্রয়োগ করা রাষ্ট্রীয় বিষয়। এক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্বও কম নয়। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধনী এনে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত করণে নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু এই আইন থাকার পরও পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ হয়নি। ২০১২ সালে পলিথিনবিরোধী অভিযান জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এজন্য একজন সচিবের নেতৃত্বে এনকোর্সমেন্ট মনিটরিং কমিটি করা হয়েছিল। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করার পর, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবারও পলিথিন, শপিংব্যাগ, পলিথিন বস্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে। পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষা করতে হলে, পলিথিন বর্জন জরুরি। পলিথিন ব্যবহার ও উৎপাদন নিষিদ্ধ অভিযান কঠোর করা গেলে, সোনালি আঁশের সোনার যুগ ফিরে পাবে কৃষক। লাভবান হবে রাষ্ট্র। বাড়বে পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার। কর্মসংস্থান হবে লাখো মানুষের ।

বৃক্ষ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পৃথিবীর প্রাণিকুলকে অক্সিজেন সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখে। বৃক্ষে বসবাস করে পরিবেশবান্ধব হাজারো প্রজাতির পক্ষীকুল। অবাধে ধ্বংস হচ্ছে বৃক্ষরাজি, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রাণিকুল। ফলে পৃথিবীতে মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনিবার্য অভিশাপ বারবার নেমে আসছে। বহু প্রজাতির বৃক্ষরাজির শুকনো পাতা, মাটিতে শুকিয়ে মাটির যেমন উর্বরতা বৃদ্ধি করে, বৃক্ষ শাখার লাখো প্রজাতির পশুপাখি, প্রাণিকুল ফলমূল খেয়ে, প্রকৃতির নিয়মেই স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জাগায় মলত্যাগ করে, এতে করেই পরিচর্যাবিহীন গাছপালা গজিয়ে আমাদের এই ভূ-ম-লকে সবুজ-শ্যামলে ভরে তোলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা এতই পবিত্র এবং রহমতের জায়গা, যেখানে পাখির বিষ্ঠা থেকে ফলের গাছ জন্মে, শেয়াল-কুকুরের মল থেকে বৃক্ষরাজির সৃষ্টি হয়। মাটি খুঁড়লেই বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়, এমন সোনার দেশ পৃথিবীর কোথায় আছে? আমরা যদি, প্রকৃতিকে ভালোবাসি, তাকে রক্ষা করি, আমাদের কখনো কারো গোলামি করতে হবে না।

যুগে যুগে এদেশের বন-বাদাড়, নির্মমভাবে ধ্বংস করায়, প্রকৃতি ন্যাড়া হয়েই চলছে। ফলে, জলবায়ুর টানা পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়, টর্নেডো, ভূমিকম্প, কালবৈশাখী, সুনামি, বজ্রঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধস, অতিবর্ষণ, অকালে খরা-বন্যা। ২০১৬-এর জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর জুলাই পর্যন্ত আমাদের দেশে বজ্রপাতের ফলে ২৯১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ১৮৫৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক তা-বে এ অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছে ৬১ লক্ষ মানুষ। ধ্বংস হয়েছে ১০ কোটি গবাদি পশু এবং ২৫ কোটির বেশি আবাসন। প্রকৃতিতে কার্বনের মাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ এবং বৃদ্ধির উৎস, বৃক্ষরাজির নির্মম ধ্বংস লীলায়। এমন অনেক বৃক্ষ-লতা-গুল্ম রয়েছে, যা প্রকৃতির কীটপতঙ্গ ছত্রাককে ধ্বংস করে দেয়। আজ প্রকৃতি এতটাই অসহায়, জলাশয় ভরাট, নদীদূষণ, উপকারি প্রাণিকুল ধ্বংস, অবাধ বৃক্ষনিধন, পাহাড় ধ্বংসের কারণে বিপর্যয়ের মুখে।

যার ফলে অজ্ঞাত রোগ-ব্যাধি, ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাসের মত লাখো ভাইরাস মানবসভ্যতাকে গ্রাস করার সুযোগ নিচ্ছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ চিরন্তন সত্য। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর ড্রেনমার্কের নাগরিক ১৬ বছর বয়সের গ্রেটা থানবার্গ ধরিত্রী রক্ষায় শত শত মানুষের সঙ্গে নিউইয়র্কের রাস্তায় মিছিল করতে বের হয়েছিল। তার আহবানে পৃথিবীর ১৮৫টি দেশের স্কুল শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এসেছিল। গ্রেট থানবার্গের মতো ধরিত্রী রক্ষক জাতি গঠনে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতার দায় সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূলের একজন অন্ধ মায়ের কাছেও এসে ঠেকেছে। গত ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইন ফরেস্ট আমাজন জ্বলছিল। পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত আমাজনে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৩০ লাখ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে।

এখানেই ৩০০ উপজাতির ১০ লক্ষ জনমানুষের বসবাস। গবেষকদের মতে, এ বন্য প্রজাতিরা ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। পৃথিবীর বায়ুম-লে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশের উৎপত্তি আমাজনে। যে কারণে আমাজান সবার, সারা পৃথিবীর। এ ব্যাপারে বলসোনারো ধিক্কারের স্বরে বলেছেন, ‘আপনাদের মতো নিষ্ঠুর বর্বর ক্ষ্যাপা ও মূর্খের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কোপানলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাজন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পুরো পৃথিবী, মানব জাতি।’ অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা উঠানামায় গ্রিনল্যান্ডেও অস্বাভাবিক মাত্রায় বরফ গলছে বলে নাসার সমুদ্র বিজ্ঞানে যশ ইউলিস ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পলিথিনের অবাধ ব্যবহারে নদীদূষণ এবং আবাদি জমির ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। বৃক্ষ নিধনের স্বতঃস্ফূর্ততায় বন-বাদাড় হারিয়ে ফেলছি।

 এ অবস্থায় আমাদের নদীনালা সংরক্ষণ, পাহাড়-জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, বৃক্ষরোপণ, জলাশয়-নদীনালা দূষণমুক্ত করতে না পারলে, মানব জাতি নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদী বিজ্ঞানীরা। বিগত ৩০০ বছরের ব্যবধানে নতুন যত রোগ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তা সবকিছুই সচেতনতার অভাবে। সম্প্রতি যে সমস্ত রোগ-ব্যাধির আবিষ্কার হচ্ছে, তা প্রকৃতির ওপর আমাদের অস্বাভাবিক আচরণেরই ফলে। গত ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৯ বছরের ব্যবধানে ৭টি নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে শুধু পরিবেশ ধ্বংসের কারণে। একইভাবে গবেষকদের মতে, করোনাভাইরাস সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং বণ্যপ্রাণীর সঙ্গে লোকালয়ের সমাগমে। রূঢ় সত্য, রক্ষিত ধরিত্রীতে সুরক্ষিত প্রাণ।

 

রহিম আব্দুর রহিম : শিক্ষক, নাট্যকার ও গবেষক

[email protected]

 
Electronic Paper