করোনার জিন বিবর্তন
শেখ আনোয়ার
🕐 ৮:৩৮ অপরাহ্ণ, জুন ০৩, ২০২০
বিভিন্ন দেশে ঝড়ের চেয়েও দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এ সময়ে এ নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। পৃথিবীর নানান প্রান্তে চলছে নিরন্তর গবেষণা। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে করোনার উৎপত্তি, প্রকৃতি, গঠন, জীবনচক্র, চরিত্র পাল্টানো, কর্মপদ্ধতি এবং জিনগত বিন্যাস। এসব বিষয়ের মধ্যে তবু এখনও বহু শূন্যস্থান রয়ে গেছে। যতটুকু জানা গেছে, তার খানিকটা সবার জন্য সহজভাবে এখানে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হল।
মোটামুটি সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে অনেকেই পড়ে থাকবেন জীবকোষে দু’ধরনের নিউক্লিয়িক অ্যাসিড থাকে। একতন্ত্রী বা রাইবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড অর্থাৎ আরএনএ এবং দ্বি-তন্ত্রী বা ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড অর্থাৎ ডিএনএ। জীবকোষের যাবতীয় কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে এই ডিএনএ এবং আরএনএ। যে সমস্ত কোষ ডিএনএ নিয়ন্ত্রিত, সেখানে ডিএনএ-এর সজ্জাবিন্যাসকে বুঝে এম-আরএনএ এবং টি-আরএনএ কোষের অঙ্গাণু রাইবোজোমের সহায়তায় বিভিন্ন প্রোটিন (নানা ধরনের উৎসচেকও হতে পারে) তৈরি করে।
এ উৎসচেকগুলো কোষ তথা মানুষের দেহের বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করে। জীবাণুগত উপাদান এবং প্রোটিনের সমন্বয়ে ভাইরাস হল একটা ছোট অসেলুলার কণা। যা জীবিত কোষগুলোকে আক্রমণ করতে পারে। ভাইরাস ডিএনএ এবং আরএনএ কোর নামে একটা প্রোটিন কোট রাখে। ভাইরাস কেবল একটা হোস্ট সেলের ভেতরে প্রতিলিপি করতে পারে। কিছু ভাইরাস একটা প্রতিরক্ষামূলক খামে আবদ্ধ থাকে। কিছু ভাইরাসের স্পাইক রয়েছে। যা হোস্ট কোষগুলোর সংযুক্তিতে সহায়তা করে। ভাইরাসের গঠন প্রকৃতি অতি ক্ষুদ্র এবং জটিল প্রকৃতির হলেও এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ব্যাপক।
করোনা অচেনা ভাইরাস নয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এটা এক বিশেষ ধরনের ভাইরাসের পরিবার। বড় ভাইরাস দলের সদস্য। এর প্রজাতি রয়েছে অনেক রকম। প্রকৃতিতে এখনও পর্যন্ত মানুষের জানা দুইশ’রও বেশি করোনাভাইরাস রয়েছে। যার মধ্যে বর্তমান করোনাসহ কেবল ৭টা সংক্রমিত হতে পারে মানুষের দেহে। ২০০৩ সালে এ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব সেই চীনেই ঘটে। তখন মানুষ জেনেছে সার্স ভাইরাস নামে। চীন যখন ব্যাপারটা প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানায়, তখন এর নাম রাখা হয় সার্স-কভ-২। বিজ্ঞান জগতে এখনও চলছে এই নামেই। নামটা ল্যাটিন শব্দ করোনা থেকে নেওয়া। অর্থ হল মুকুট। সত্যিই মুকুটের মতো দেখা যায় ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে। ভাইরাসের উপরদিকে প্রোটিনসমৃদ্ধ থাকে। এ ভাইরাসের স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত ৪টা প্রোটিন রয়েছে।
যার নাম স্পাইক বা এস, এনভেলপ বা ই, মেমব্রেন বা এম এবং নিউক্লিওক্যাপসিড বা এন। তবে এন-প্রোটিন ভাইরাসের আরএনএ জিনোমকে একত্রে খোলকের মধ্যে ধরে রাখে। অন্যদিকে এস, ই, এম প্রোটিনগুলো ভাইরাসের বাহ্যিক আকার আকৃতি গঠনের উপাদান হিসেবে কাজ করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভাইরাসটা মানুষের তৈরি নাকি প্রাকৃতিক? সম্প্রতি ‘ন্যাচার মেডিসিন’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় মানুষের তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাকে সর্ম্পূণভাবে খারিজ করে জোর দাবি করা হয়েছে ভাইরাসটা পুরোপুরি প্রাকৃতিক। বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মানুষের দেহকোষের ভেতরে অনবরত জিনগত পরিবর্তন বা ‘মিউটেট’ করছে এ ভাইরাস।‘ মিউটেশন হলো কোষ জিনোমের ডিএনএ গঠনে পরিবর্তন। সহজ ভাষায়, ডিএনএ বা আরএনএ’ র জিনোমে নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্সে কোনো ধরনের পরিবর্তন এলে তাকে মিউটেশন বলা হয়।
জিনের পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে এই মিউটেশনের মাধ্যমে। করোনাভাইরাস এ ডিএনএ বা আরএনএ কে অন্য কোনো হোস্ট বা বাহকের দেহে প্রবেশ করে সেখানে রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। চীনের নাঙ্কাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুয়ান জোশু এবং তার সহ-গবেষকরা লক্ষ করেন, ‘করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন মানবকোষের বিশেষ কিছু রিসেপ্টরকে কোষে ঢোকার জন্য ব্যবহার করে। ভাইরাসের আরএনএ রেপ্লিকেশন ঘটে অনেক কম সময়ে এবং এদের মিউটেশনের হার অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে তুলনামূলক বেশি।’
কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, ‘রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরির সময় ভাইরাসগুলো প্রুফ-রিড করে না। রেপ্লিকেশনের সময় নিউক্লিওটাইড বেইজ পেয়ারের কোনো অংশ মুছে যায় বা নতুন করে কোনো অংশের সংযোজন হয়।‘ অর্থাৎ প্রতিলিপি তৈরি বা পুরাতন আরএনএ স্ট্র্যান্ড থেকে নতুন স্ট্র্যান্ড তৈরির সময় কোনো ভুল হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে না এই চরিত্রহীন ভাইরাস।
গবেষকরা ব্যাখ্যা করেন, ভাইরাসটা বিটা করোনাভাইরাস পরিবারের সার্বেকো ভাইরাস সাব জেনাস-এর সদস্য। এটা এক ধরনের পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস। আরএনএ ভাইরাস হতে পারে দু’রকম। পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস ও নেগেটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস। পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস হোস্ট বা মানুষের কোষে ঢুকে নিজেই নিজেকে এমআরএনএ (সজঘঅ) হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ কাজে মানুষের কোষের জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালের কোনো সাহায্য লাগে না। নেগেটিভ সেন্স ভাইরাসরা অবশ্য তা পারে না। তাদের আরএনএ জটিল প্রক্রিয়ায় নিজেরা প্রাণে না মরে পজিটিভ সেন্স প্রতিলিপি তৈরি করে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে।
করোনা এক ধরনের পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস হওয়ায় মানুষের শরীরের কোষে ঢুকে সরাসরি নিজেকে ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনীয় এনজাইম নিজেই তৈরি করে। যে এনজাইম বা উৎসচেক হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বর্পূণ বহুক্রিয়া সম্পন্ন প্রোটিন। যা ভাইরাসের নিজস্ব এমআরএনএ গঠন এবং জিনোমের প্রতিলিপি গঠন অর্থাৎ ডুপ্লিকেশনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীদের মতে, এটা রিসেপ্টার অ্যাঞ্জিয়টেন্সিন কনভার্টিং এনজাইম-এসিই২ (অহমরড়ঃবহংরহ-পড়হাবৎঃরহম বহুুসব২) নামে একধরনের প্রোটিন ছাড়াও ফিউরান নামে মানব কোষের আর একটা প্রোটিনকে পরিবর্তন করে সংক্রমণ জারি রাখতে পারে। তাই সংক্রমিত ব্যক্তি যদি আগে থেকেই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস কিংবা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত থাকেন, তাহলে ভাইরাসের জন্য সোনায় সোহাগা। খুব সহজেই এধরনের সংক্রমিতের কোষে দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। কারণ এ ধরনের (অ্যাঞ্জিয়টেন্সিন কনভার্টিং এনজাইম-এসিই২) রিসেপ্টর প্রোটিনের জন্য সাধারণত তারা এমনিতেই ওষুধ খেয়ে থাকেন। এ জাতীয় ওষুধ খাওয়ার ফলে তাদের শরীরে এ ধরনের রিসেপ্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
ফলে, তাদের শরীরে করোনার মরণশক্তি আরও হাজার গুণ বেড়ে যায়। সেজন্যে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন এ ধরনের রোগীদের সাবধানে থাকতে বারবার পরার্মশ দেয়। এ বদগুণ এইডস ভাইরাসেরও রয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হল, ছোটখাটো বিচিত্র মিউটেশনগুলোর কারণেই ভাইরাসটার সংক্রমণের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এভাবে করোনার ২৬ হাজার জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা করেছেন। ইতোমধ্যেই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এওঝঅওউ-এ ভাইরাসের ৩৫০ এর বেশি জিনোম সিকোয়েন্স শেয়ার করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের করোনা ইতালি থেকে এসেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের করোনার জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণায় সফল হয়েছেন প্রখ্যাত অণুজীব বিজ্ঞানী ড. সমীর কুমার সাহা ও তার মেয়ে ড. সেজুঁতি সাহা। আশা করা যায়, সবচেয়ে কার্যকর পন্থায় রোগ নিয়ন্ত্রণ বা নতুন ভ্যাকসিন তৈরিতে এ গবেষণা সহায়ক হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তবে চীনের ল্যাবে কি করোনাভাইরাসের উৎপত্তি? যারা আঙুল উঁচিয়ে হ্যাঁ বলেন, তাদের অণুজীব বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানান, ‘জি না। ভাইরাসটা আমেরিকাতেও ছিল।’ দেশে দেশে ভৌগোলিক আকার ও আবহাওয়ায় ভাইরাসটা পরিবর্তিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, যখন কোনো ভাইরাস নতুন কোনো অঞ্চলের মানুষ বা পরিবেশে ঢুকতে চায়, তখন সে নিজের জিনগত ধরন বদলানোর চেষ্টা করে। যে মানুষটার শরীরে এটা ঢুকেছে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা ও জেনেটিক ধারা অনুযায়ী নিজের ধরনকে পাল্টে নেয় ভাইরাস।
এভাবেই দেশে দেশে অনুকূল পরিবেশে ভাইরাসটার বিবর্তন হয়েছে এবং তা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বার্লিনের এক ভাইরাসবিদ ইতালিতে সংক্রমিত এক জার্মান রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্স বের করেন। দেখা যায়, সেই নমুনা এক মাস আগে জার্মানির মিউনিখে সংগৃহীত অন্য এক নমুনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে। দু’টো নমুনা একই ধরনের মিউটেশন বহন করছে। যা চীনে সংক্রমিত ভাইরাস নমুনায় অনুপস্থিত।
গবেষকরা এখান থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ‘ইতালিতে ছড়িয়ে পড়া করোনার বীজ হয়তো সুপ্ত ছিল জার্মানিতেই। অথবা হতে পারে একই ধরনের মিউটেশন ঘটিয়ে ভাইরাস দু’টো ভিন্ন পথে একই সঙ্গে দু’দেশে প্রবেশ করেছে।‘ এ থেকে প্রমাণিত হয়, ভাইরাস নিজেকে দ্রুত বিকশিত করতে সক্ষম এবং এর মিউটেশনের ধরন দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন হয়। ভাইরাসের এমন অদ্ভুত মিউটেশনে অবাক বিজ্ঞানী মহল। দেশে দেশে করোনার এ জেনেটিক বিবর্তনের ফলে ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরি নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে যত সমস্যা। কারণ ওষুধ বা প্রতিষেধক যা-ই হোক না কেন।
তাকে দু’টো আক্রমণ পদ্ধতিই নিষ্ক্রিয় করতে হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। এ যাবৎ শতাধিক ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য দেওয়া হয়েছে। কয়েকটার হিউম্যান ট্রায়ালও হয়েছে। কোনোটাই কোনো কাজে লাগছে না দেখে বিশ্বের সব বিজ্ঞানীর ঘুম হারাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও শঙ্কার কথা জানিয়ে দেয়, ‘করোনার ভ্যাকসিন হয়ত কোনো দিনই বের হবে না!’
সময় বয়ে যায়। মানুষের প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশা রয়ে যায়। আগামী দিনে হয়ত বের হতে পারে নতুন অন্য কোনো ভ্যাকসিন। অন্য ভ্যাকসিন কতটা কাজের কাজ করতে পারবে? সেই ভ্যাকসিন কি তবে সব রকমের ভৌগোলিক আবহাওয়া পরিস্থিতিতে একই রকম কার্যকর হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীদের এখনও অজানা। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ, নিয়মিত হাত ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করা, সার্জিক্যাল মুখোশ পরা, হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা, ঠাণ্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া এ মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই। তাই আসুন। যে যেভাবে পারি সচেতন করি অন্য সবাইকে। অবস্থান করি নিরাপদে। মনে রাখতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো ছোট্ট একটা পদক্ষেপে হয়ত বেঁচে যেতে পারে হাজারো প্রাণ।
শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়