করোনা প্রাদুর্ভাব ও প্রকাশনা সংকট
মঈন মাহমুদ
🕐 ৮:২২ অপরাহ্ণ, জুন ০৩, ২০২০
প্রকাশনা শিল্পেও কালোছায়া ফেলছে করোনাভাইরাস। বিশেষ করে সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনেক বেশি। আমাদের প্রকাশনার প্রায় শতভাগই চীন থেকে আমদানি নির্ভর। চীনের উহান প্রদেশে যখন প্রথম করোনা পরিলক্ষিত হয় তখন থেকেই সে দেশের সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। চীন থেকে বাংলাদেশে আসা পণ্য কমতে থাকে।
ফলে করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই প্রকাশনা শিল্পে সংকট সৃষ্টি হতে থাকে। প্রকাশনার শিল্পের কাঁচামাল যেমন কালি, কাগজ, প্লেট, ফিল্ম, ক্যামিকেল ইত্যাদির চালান আসা কমে যেতে থাকে। যেজন্য গেল বইমেলার প্রাক্কালেই প্রকাশকদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া শুরু হয়। প্রায় সবাইকেই পুরনো অর্ডার লস দিয়ে করে দিতে হয়েছে।
দেশে লকডাউনের ফলে মূলত বৃহত্তর সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এ সংকটকালে স্বভাবতই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। বই আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে পড়ে না। পেটে ক্ষুধা নিবারণের পর মধ্যবিত্ত শিক্ষিতজনরাই সাধারণত সৃজনশীল বইয়ের পাঠক ও ক্রেতা। ফলে বই প্রকাশনা ও প্রকাশনা সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি আড়ালে থেকে যায়। কিন্তু অন্যান্য ব্যবসার মতো বইয়ের প্রকাশনায়ও অনেক পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়।
প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা দেশের অন্য যেকোনো বিপর্যয়ে সবার আগে বই কেনা বন্ধ হয়ে যায়। তাই বই ব্যবসায় বা প্রকাশনায় ঝুঁকিও বেশি। বই কেনা যেহেতু মানুষের আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে তাই মানুষের আর্থিক সংকট থাকলে প্রকাশনা ব্যবসার দুরবস্থা কাটবে না। লকডাউনের কারণে সব ধরনের সামাজিক লোকাচার, উৎসব আয়োজন, সাংস্কৃতিক কর্মকা- বন্ধ।
জনসম্মুখে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, ঈদ উদযাপন বন্ধ রাখা বা সীমিত আকারে করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এ বছরেই। এ উপলক্ষে সরকার ২০২০-২০২১ সালকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করে এবং একে কেন্দ্র করে ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অন্যদিকে ২০২১-এ আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। এ উপলক্ষেও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সৃজনশীল প্রকাশকরাও এ জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং প্রকাশনা কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সবাই সংকটে পতিত হয়। সাধারণ প্রেস মালিক এবং প্রকাশনা ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা ঈদ উপলক্ষে দেশজুড়ে ঈদ শপিংয়ের জন্য লক্ষ কোটি শপিং ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস তৈরি করে থাকে। এবার তাও করা যায়নি। করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় অনেক দেশে ক্রমান্বয়ে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখার জন্য এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশেও লকডাউন শিথিল করা হয়েছে।
৩১ মে’র পর সাধারণ ছুটি আর না বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা সমস্যা খুব সহজে যাবে বলে মনে হয় না। ফলে প্রকাশনার ক্ষেত্রে সংকটও সহজে কাটবে না।বই প্রকাশনা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়াধীন ও শ্রমঘন কাজ। কয়েক স্তরে এর কাজ সম্পন্ন হয়। একজন লেখক তার বইটি ছাপার উপযোগী করে পাণ্ডুলিপি আকারে প্রকাশককে দিয়ে থাকেন। তারপর প্রকাশক প্রয়োজন বোধ করে সেটি প্রকাশের উপযুক্ত কিনা তা বিবেচনা বা মূল্যায়ন করেন। মূল্যায়ন শেষে তা প্রকাশের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।
এ ব্যবস্থাপনায় কম্পোজ ও ডিজাইন হাউস, কাগজ বিক্রেতা, ছাপাখানা, লেমিনেটিংয়ের দোকান, বাঁধাইখানা ও বিক্রেতা এমন সব প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়। আর এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষ ও তাদের পরিবার। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রুফ রিডিং এবং প্রচ্ছদ এঁকেও রোজগার করে থাকেন। এখন তারা সবাই সংকটে।এ সংকট মোকাবেলায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি ও বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থার এ শিল্পের প্রতি নজর দিতে হবে। কেননা, একটি জাতির ভাষা ও মননের বিকাশের জন্য সৃজনশীল প্রকাশনার গুরুত্ব অনেক। সেজন্য এ শিল্পের টিকে থাকা ও সংকট উত্তরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
যেমন, সরকারি উদ্যোগে বইকেনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, আর্থিক প্রণোদনা, কৃষিশিল্প ও অন্যান্য খাতের ন্যায় কম সুদে ঋণ সহায়তা প্রদান, রেয়াতি হারে কাগজ কেনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। অনলাইনে বই বিপণনের ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বিশেষ ছাড় দিয়ে সহায়তা করতে পারে।বাংলা একাডেমি প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে থাকে। বলতে গেলে তারাও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুফল ভোগকারী এবং অন্যভাবে অভিভাবকও। মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একাডেমির বিশেষ উদ্যোগ থাকা জরুরি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিবছর বেসরকারি পাঠাগারের জন্য প্রায় আড়াই কোটি টাকার বই কেনে থাকে। গণগ্রন্থাকার কেনে এক কোটি ৭৮ লাখ টাকার বই। ইসলামি ফাইন্ডেশন এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বই কিনে থাকে।
প্রকাশকদের দাবি এই বই কেনা এখনই শুরু করা গেলে এবং গণগ্রন্থাগারের কেনা বইয়ের বিল স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান বা লেখকের ব্যাংক হিসাবে প্রেরণ করলে তাদের অনেকটা সহায়তা হয়। দেশে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য প্রকাশক ও বিক্রেতা রয়েছেন প্রায় ১২ হাজার। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক ও প্রকাশক সমিতির সদস্যভুক্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২০৫টি। এছাড়া আরো অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকা শহরে বাঁধাইখানা রয়েছে আড়াইশ’র অধিক। সবকিছু এখন বন্ধ। প্রকাশকদের মতে, এমনিতে প্রকাশনা এখনো পুরোপুরি শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
এর মধ্যে চলমান সংকটে পড়ে এর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ব্যবসা বন্ধ। কিন্তু অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, গুদাম ভাড়া এগুলো বহন করতে হচ্ছে। সকলেই পুঁজি সংকটে পড়ছেন। এ অবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পুঁজির প্রয়োজন। ফলে সহায়তা বা প্রণোদনা না পেলে অনেক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বিশেষ করে নবীন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের প্রকাশকরা আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। জানা গেছে, প্রকাশনা খাতে সরকারের করণীয় নির্ধারণে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে প্রকাশকরা বলেন, ইতালিতে লকডাউন-পরবর্তী সময়ে সবার আগে যে প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে সেটা হলো লাইব্রেরি। প্রকাশনাখাত বর্তমানে যে সংকটে পড়েছে তা থেকে উত্তরণে আমরা সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। উত্তরণ কীভাবে হবে তা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকেও হয়ত অনেক কিছু বদলাতে হবে, নতুন করে ভাবতে হবে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নারী উদ্যোক্তা ঊষার দুয়ার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কাব্য সুলতানা বলেন, করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে আমরাও পাঠককে ভালো কিছু দিতে চাই। আমাদের প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছি। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাক্লুহান বলেছেন, মাধ্যমই বার্তা। যোগাযোগের উপায় হিসেবে প্রিন্ট মিডিয়া এখনো পর্যন্ত সর্বোৎকৃষ্ট।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বেসরকারি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডে ‘সুবোধ’ নামে একটি সুদমুক্ত বই ঋণসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে। মেলা প্রাঙ্গণে আইপিডিসির স্টলে বইপ্রেমীদের জন্য বিনা সুদে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে, যা তিন মাসের কিস্তিতে পরিশোধ্য ছিল। এটি তরুণ প্রজন্মকে বেশি বেশি বই পড়ায় উৎসাহিত করতে এবং বই পড়ার সংস্কৃৃতি ফিরিয়ে আনতে এটি তাদের বিশেষ উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠানটি চাইলে করোনাউত্তর পাঠকদের পাশাপাশি সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুরূপ কিছু করতে পারে। এতদ্ব্যতীত সংকট উত্তরণে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠাগুলোকেও পাঠক সৃষ্টিতে মনোযোগী হতে হবে।
মঈন মাহমুদ : লেখক ও প্রকাশক