নজরুল : সাম্য ও সম্প্রীতির বাতিঘর
জি এম শহিদুর রহমান
🕐 ৮:০৩ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০২০
নজরুল বাংলা সাহিত্য গগনে ধূমকেতুর মত হঠাৎ উদিত হয়ে হঠাৎই অস্তমিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার সাহিত্য কালোত্তীর্ণ। প্রকৃতপক্ষে তার চিন্তা-চেতনায় দেশ-কালোত্তীর্ণ সর্বজন কল্যাণকামী প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। নজরুল তার স্বোপার্জিত জ্ঞান দিয়ে অন্তরলোক এমনভাবে বিনির্মাণ করেছেন যেখানে কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী, পুরুষ, দেশ ও কালের ভেদ-বিভেদ নেই; আছে শুধু সাম্য ও সম্প্রীতির জয়জয়কার। যা আজও আমাদের সংকটকালীন মুহূর্তে আশাবাদী হওয়ার প্রণোদনা জুগিয়ে থাকে।
সেকালে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রকট আকার ধারণ করেছিল; নারী শিক্ষার ব্যাপারে একধরনের বিরূপ মনোভাব দেখা যেত, বিশেষ করে মুসলিম সমাজে। আসলে কোনো ধর্মই মানুষে-মানুষে কিংবা নারী-পুরুষে বিভেদ সৃষ্টির রসদ জোগায় না বরং ধর্ম ব্যবসায়ীরাই এগুলো করে থাকে। আবার ধর্ম ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয় নানা রকম কুসংস্কার। কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা, শিক্ষাই পারে মানুষকে আলোর পথ দেখাতে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করতে নজরুল তার সাহিত্য-সাধনার মধ্য দিয়ে নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন। সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেওয়া আমাদের ধর্মের আদেশ’।
আমরা আজ নারী শিক্ষার বেশ বিস্তার ঘটাতে পেরেছি। কিন্তু নারীর প্রতি নানা রকম জুলুম-নির্যাতন কি বন্ধ করতে পেরেছি? নজরুল সেদিনের ঐ বক্তৃতার আরো পরের দিকে বলেছিলেন, ‘খোদার রাজ্যে পুরুষ আজ জালিম, নারী আজ মজলুম’। আজকের দিনেও এই কথাটা পুরোপুরি সত্য। আমরা এখনও নারীর অবদানকে সমান মর্যাদা দিই না, নারী শ্রমিকরা অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিক পায় (সর্বক্ষেত্রে নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে)। অথচ নজরুলের দৃষ্টিতে, ‘বিশ্বে যা-কিছু সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। তিনি শুধুই কি নারীর অধিকার নিয়ে কলম ধরেছেন? সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষÑ কৃষক, শ্রমিক ও জেলেদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও শোষণ-বঞ্ছনার অবসান ঘটানোর নিমিত্তে তাদের নিয়ে নজরুলের মতো এত যতœসহকারে আর কজন সাহিত্যিক ভেবেছেন, লিখেছেন?
নজরুলের সমকালে ছুঁৎমার্গ প্রথার প্রচলন ছিল। এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের কাউকে ছুঁয়ে দিলে জাত চলে যেত। অন্যদিকে ধর্মের নামে জাতিতে-জাতিতে বিদ্বেষ, মারামারি ও হানাহানি বলতে গেলে নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। জাতের নামে এই বজ্জাতি তিনি কখনো বরদাস্ত করেনি। ১৯২৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেছেন,‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কা-ারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’ কে হিন্দু? কে মুসলিম? কে বৌদ্ধ? এসব ধর্মীয় পরিচয় তার কাছে বড় হয়ে ওঠেনি, বরং মানুষই তার কাছে মুখ্য বিষয়।
নজরুল নিজে ইসলাম ধর্মে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠে প্রতিষ্ঠা করলেন মানবধর্ম। এ যেন চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’উক্তির প্রতিফলন। নজরুল তার সাহিত্যে বিভিন্ন ধর্মের পুরাণে ব্যবহৃত শব্দাবলি, প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ যেভাবে সংস্থাপন করেছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু এজন্য তাকে প্রচুর সমালোচনা ও নিন্দা হজম করতে হয়েছে। একদিকে কট্টরপন্থী মুসলমানরা কাফের বলে ভৎসনা করে, অন্যদিকে গোঁড়া হিন্দুরা তাকে বর্জন করে।
তার মতে, সাহিত্যে সবার সমান অধিকার। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, তেমনি হিন্দুরও মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করেছেন সে তাঁর দৈব। তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলে নিজেকে কবি বলে দাবি করেছেন। তিনি তার সারাজীবনের সাহিত্য-সাধনার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্পীতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন; তিনি হাতাহাতিকে হ্যান্ডশেকে, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
সকল ধর্মের উদ্দেশ্য অভিন্ন, আর তা হলো বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং ধর্মের মূল শক্তি হল পরমতসহিষ্ণুতা। অথচ আমরা প্রায়ই এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখি। আর হালের দুনিয়ায় ভিন্ন মত-পথকে তো শ্রদ্ধা করা দূরের কথা বরং ভিন্ন মতের অনুসারীদের হত্যা করার মত জঘন্য ঘটনাও ঘটেছে এবং তা করা হচ্ছে ধর্মের নামে! যার আপডেটেড রূপ হলো জঙ্গিবাদ। আর জঙ্গিবাদ এখন পুরো মাত্রায় আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। যারা জঙ্গিবাদের মতো মানবতাবিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী, তারা মনে করে চাপাতি আর বোমার আঘাতে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
কিন্তু ইতিহাস বলে কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নয় বরং সৎ আদর্শ দিয়ে মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং তাদের মতবাদ ভুল আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যারা ধর্মের নামে মানুষকে পীড়ন করে তাদের নজরুল বিষধর সাপের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে এখানে তার গোঁড়ামি ধর্ম নয় শীর্ষক কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করছি ‘ধর্ম জাতির নাম লয়ে এরা বিষাক্ত করে দেশ,/এরা বিষাক্ত সাপ, ইহাদের মেরে কর সব শেষ।/ নাই পরমত-সহিষ্ণুতা সে কভু নহে ধার্মিক,/এরা রাক্ষুস-গোষ্ঠী ভীষণ অসুর-দৈত্যাধিক।/উৎপীড়ন যে করে , নাই তার কোনো ধর্ম ও জাতি,/জ্যোতির্ময়েরে আড়াল করেছে, এরা আঁধারের সাথী’।
যারা ধর্মের নামে মানুষ মারে, তারা আসলে অন্ধকার পথের যাত্রী। স্রষ্টাকে পেতে হলে স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। অর্থাৎ মানুষ হত্যা করে আল্লাহকে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। সম্ভবত এই কারণে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। নজরুল তার ঈশ্বর কবিতায় বলেছেন, ‘স্রষ্টারে খোঁজো আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!/ ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ-কায়া,/ দেখিবে, তোমার সব অবয়বে পড়েছে তাহার ছায়া’। অর্থাৎ মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বরের বসবাস। আবার মহাপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও প্রায় একই কথা বলেছেন। আর তা হলো ‘যত্র জীব তত্র শিব’। এ অমর বাণীগুলো উপলব্ধি করলে কারোর পক্ষে জঙ্গিবাদ কিংবা যেকোনো ধরনের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়।
আসলে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সমগ্র সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে এমন এক বি্শ্ব ব্যবস্থা নির্মাণ করেতে চেয়েছিলেন যার ভিত্তি হবে সাম্যবাদ। (উল্লেখ্য নজরুলীয় সাম্যবাদ মার্কসীয় সাম্যবাদ থেকে স্বতন্ত্র) যেখানে থাকবে না জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, ধর্মে-ধর্মে কোলাহল, নারী-পুরুষের বৈষম্য; থাকবে কেবল মানুষে-মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন। সেই সমাজ ব্যবস্থার চিত্র নজরুলের ভাষায় এরকম ‘সাম্যবাদী-স্থান/নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।/নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর।/নাই কো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।/এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশ্ত্, এখানে বিভেদ নাই,/যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!/নেই এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কোলাহল,/পাদরী-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।’
জি এম শহিদুর রহমান : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়