ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হাইড্রোপনিক, মাটিবিহীন ভবিষ্যৎ কৃষি!

সাজন আহম্মেদ পাপন
🕐 ৬:৩৩ অপরাহ্ণ, মে ২৯, ২০২০

শিরোনামটা অবাক হওয়ার মতোই। বিশেষ করে যারা ‘হাইড্রোপনিক’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন, কিংবা যারা ভাবেন মাটি ছাড়া আবার কৃষিকাজ হয় কীভাবে! কৃষি মানেই তো মাটি, কাদা, ঘাম, ধুলোবালি। এখানে মূল উপাদান মাটি ছাড়াই কৃষি? বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের কৃষক, কৃষি মানেই তো মাটির ঘ্রাণ। সেখানে মাটি ছাড়া কৃষি ফলন কীভাবে। আশ্চর্য হলেও বাস্তবতা সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতা কৃষির নিত্য আপগ্রেডেশনেরই একটি অবস্থা হচ্ছে হাইড্রোপনিক বা সরাসরি পানির মাধ্যমে কৃষিজ উৎপাদন।

পৃথিবীর আবহাওয়া, জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে চলমান খাদ্যনিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিতে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষ করে বিগত শতাব্দীর শুরুর কৃষির সঙ্গে এ শতাব্দীর কৃষি বাস্তবতার বিরাট ব্যাবধান পরিলক্ষিত হয়। বিগত শতাব্দীতেই মানুষ বুঝতে পারে নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা তথা সুষম খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষিকে প্রযুক্তির আওতায় আনার বিকল্প নেই। দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার যে খাদ্য চাহিদা তা পূরণে আদিম আমলের চাষপদ্ধতি দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। তাই বিশ্ব নেতৃত্বও কৃষিকে সেভাবেই মূলধারায় সংযুক্ত করে ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তায় নজর দেয়। চলমান সে প্রক্রিয়ারই একটি ধাপ হচ্ছে এই ‘হাইড্রোপনিক’ বা পানিতে কৃষি উৎপাদন।

বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক চাষ পদ্ধতি : ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এদেশের আবহাওয়া ও পানীর উপর হাইড্রোপনিক চাষ পদ্ধতির সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম  গবেষণা শুরু করেন। অতঃপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক পদ্ধতির গবেষণা শুরু হয় টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস ও স্ট্রবেরি নিয়ে। আরও এক বছর পরে ২০০৮ সালে তার সঙ্গে যোগ হয় ক্ষীরা, শসা, গাঁদা পুল ও বেগুন। এভাবে ২০০৯ সালে বামন শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি এবং চন্দ্রমল্লিকা অতঃপর ২০১১-১২ অর্থবছরে এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদশের জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস, স্ট্রবেরি, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শশা, ব্রোকলি, ক্ষীরা, বেগুন এমনকি গাঁদাফুল ও চন্দ্রমল্লিকার উৎপাদনে সক্ষম হয়।

বারির পটুয়াখালী উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সারা বছর তরমুজ উৎপাদনের প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে প্রদান করেছেন। বারির হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি বিএআরসি ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ফসল চাষের জন্য ঢাকার মহাখালীতে শহর পর্যায়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে অনেক সম্প্রসারণ কর্মীকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চাষ ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা বেশ এগিয়ে গেছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ চলমান আছে। 

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ একুয়াপনিক কালচার পদ্ধতির ওপর গবেষণা করছে। এ পদ্ধতিতে পানির ট্যাংকে পিলেট খাদ্য দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পানির ওপর ককশিট দিয়ে সবজির চাষ চলছে। আলাদা জায়গায় চারা তৈরি করে সারা বছর এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে পানিতে মাছের পোনা মজুদ করা হয়। শীতকালে টমেটো, লেটুস, পুদিনা এবং গ্রীষ্মকালে ঢেঁড়স, পুঁইশাক ও কলমি চাষ করা যায়। শীতকালে গিফট তেলাপিয়া ও মনোসেক্স তেলাপিয়া এবং গ্রীষ্মকালে এর সঙ্গে থাই কই, ভিয়েতনামি কই, সরপুঁটি ও লাল তেলাপিয়া চাষ হচ্ছে।

হাইড্রোপনিক ফার্মিং পদ্ধতি : হাইড্রোপনিক ফার্মিং কেবল চারা উৎপাদনের সময় ছাড়া কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করার দরকার হবে না। এ পদ্ধতিতে পটে পাথর নুড়ি বা স্পঞ্জ দিয়ে পূর্ণ করে তাতে শুধু চারা উৎপাদন করা হয়। পরবর্তীকালে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণে এ চারা রোপণ করে ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, মিডিয়া পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিক ফার্মিং করতে গাছের চারা দ্রবণে রোপণ না করে মাটি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে রোপণ করে সেখানে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণ প্রয়োগ করতে হবে। মাধ্যম হিসেবে অজৈব ও জৈব উভয় প্রকার মাধ্যমই ব্যবহার করা যাবে।

বালি কণা, কৃত্রিম কাদা অজৈব মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে তিন মিলিমিটার ব্যাসার্ধের চেয়ে কম আকারের বালিকণা ব্যবহৃত হয়। জৈব উপাদানের মধ্যে কাঠের গুড়া এবং ধানের তুষ বা তার ছাই ব্যবহার করা হয়। এতেও ড্রিপিং পদ্ধতিতে নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করতে হবে। তৃতীয়ত, এরোপনিক্স পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক অথবা সময় সময় ফসলের মূলে নিউট্রিয়েন্ট স্প্রে করা লাগে। এখানেও কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করা হয় না বলেই একেও হাইড্রোপনিক কালচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে শুনেই আগ্রহী কৃষকদের কাজ শুরু করতে হবে। প্রযুক্তিকে সামর্থ্যরে সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগ্রহীদের সহায়তার জন্য সরকারি পর্যায়েও প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন।

সরকারিভাবে ও বেশকিছু এনজিওর মাধ্যমে হাইড্রোপনিক চাষে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য চেষ্টা চলছে। ব্র্যাক ভূমিহীন কৃষকদের হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষের কৌশল শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। গত ২০১২ সালে এ প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর, নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জের ১০০ ভূমিহীন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়। এসব কৃষককে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করার জন্য দশটি করে বাকেট এবং নিউট্রিয়েন্ট সলুশন সরবরাহ করা হয়। তাদের এ উদ্যোগ অব্যাহত আছে। গ্রিন লিফ এগ্রো মহাখালিতে এর সেল সেন্টারে হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট সলুশন বিক্রি করে থাকে।

আলফা এগ্রো প্রান্তিকও এ পদ্ধতিতে চাষের কাজ শুরু করেছে। বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল বিশিষ্ট হাইড্রোপনিক ফার্ম করার পরিকল্পনাও এগিয়ে চলেছে। এখনও এ ধরনের ফার্মিং ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠলেও শিগগিরই গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। তাহলেই কৃষি আর শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং সম্প্রসারিত হবে নিয়ন্ত্রিত বহুতল বিশিষ্ট হাইড্রোপনিক খামারে। বাংলাদেশের কৃষি রূপান্তর হবে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে।

সম্ভাব্য প্রতিকূলতা : হাইড্রোপনিক পদ্ধতির গবেষণার পাশাপাশি প্রযুক্তি বিস্তারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি বিস্তারের জন্য আরো প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভূমিহীন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে ফসলে রোগ বালাই ৮০ শতাংশ কম হয়, ফলনও হয় প্রায় তিনগুণ। বিষয়গুলো এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষক লাভবান হবে এ বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। সকল পর্যায়ে হাইড্রোপনিক চাষ ও খামার গড়ে তোলার জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আগ্রহীদের সহায়তা করার জন্য সরকারের কৃষি অধিদপ্তরকে সার্বক্ষণিক তৎপর থাকতে হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে গৃহীত পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে গেলে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুষ্টিহীনতা দূরীকরণের অন্যতম হাতিয়ার হবে এ ‘হাইড্রোপনিক’ চাষ পদ্ধতি।

সাজন আহম্মেদ পাপন : সাংবাদিক, কিশোরগঞ্জ

 
Electronic Paper