ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাউল রণেশ ঠাকুর ও পরাজিত আমরা

ওয়াসিম ফারুক
🕐 ৮:১০ অপরাহ্ণ, মে ২১, ২০২০

বাউল রণেশ ঠাকুরের কায়াটা ঠিকঠাক থাকলেও অন্তর পুইড়া অঙ্গার হইয়া গেছে। রণেশ ঠাকুর বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম শিষ্য। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে শাহ আব্দুল করিমের পাশের বাড়িই রণেশ ঠাকুরের। উজানধল গ্রাম আজ দেশ বিদেশে অনেকের কাছে পরিচিত ও প্রিয় একটি গ্রাম শুধু শাহ আব্দুল করিমের জন্যই। অনেক বাউল শিল্পীর কাছে এই গ্রাম তীর্থস্থানও বটে। গত রোববার ১৭ মে গভীর রাতে কে বা কারা বাউল রণেশ ঠাকুরের বাড়ির গানের ঘরটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দেয়। এই ঘরে দীক্ষা নিতেন দূরদূরান্ত থেকে আসা রণেশ ঠাকুরের ভক্ত ও শিষ্যরা।

এখানেই থাকত রণেশ ঠাকুরের বাউল গানে ব্যবহৃত সকল বাদ্যযন্ত্র ও গানের খাতা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে জীবনের অনেক ত্যাগের বিনিময় আগলে রেখেছিলেন এই ঘরখানা, বাদ্যযন্ত্র ও গানের খাতাগুলোকে। এই ঘরে বাউল রণেশের বাবা বাউল রবনী মোহন চক্রবর্তী গানের চর্চা এবং তালিম দিয়েছেন শিষ্যদের। রণেশের বাবা রবনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন ভাটি অঞ্চলের একজন পরিচিত কীর্তনীয়া।

রবনী মোহন চক্রবর্তীর দুই ছেলে রণেশ ঠাকুর আর রুহী ঠাকুর দুই জনই ছিলেন বাউল শাহ আব্দুল করিমের শিষ্য। শুধু শিষ্য বললে ভুল হবে ছিলেন পুত্র সমতুল্য। তাই গানের পরিবেশেই বেড়ে ওঠা। রণেশ ঠাকুর ও রুহী ঠাকুর সারাজীবনই শুদ্ধভাবে গেয়েছেন শাহ আব্দুল করিমের গান। রুহী ঠাকুর আজ আর বেঁচে নেই। তবে রণেশ ঠাকুর এখনও ভাটি অঞ্চলে গেয়ে চলেছেন শাহ আব্দুল করিম ও নিজের লেখা গান।

আমাদের পুরনো ঐতিহ্য যখন সব হারাতে বসেছি তার মধ্যেও যুগ যুগ ধরে নানান ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে বাউলরা টিকিয়ে রেখেছেন বাউল ঐতিহ্যকে। বাউলরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন। বৈষ্ণববাদ এবং সুফিবাদের প্রভাবিত বাউল সম্প্রদায়। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। সাধারণত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেন। তাই ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

 তারপরও কেন শকুনের কালো থাবা বারবার আঘাত করছে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে। এর আগে ২০১৬ সালে আমরা নারকীয় তা-ব দেখেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মোবাইল ফোন কেনাকে কেন্দ্র করে দোকানিদের সঙ্গে সহিংসতায় নিহত সহপাঠীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তা-ব চালিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয় সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ও জাদুঘর। আগুনে পুরে ছাই হয়ে যায় খ্যাতনামা এই সুরসাধকের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, তার লেখা চিঠি ও দুর্লভ ছবি। ২০১৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নিয়াজ মুহম্মদ স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত উন্নয়ন মেলার মঞ্চে বাউল শিল্পী শামসুল হক চিশতি ওরফে চিশতি বাউলের ওপর হামলা করে উগ্র স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্ররা। ২০১০ সালেও শাহ আব্দুল করিমের বাড়িতে হামলা হয়েছিল শুধু এই বাউল গানের জন্য। শাহ আব্দুল করিমকে শুধু গানের জন্যই এলাকা ছাড়া করেছিল তৎকালীন ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। রাজবাড়ীর পাংশায় আমরা দেখছি ধর্মের নামে অধর্মের কাহিনী। স্থানীয় মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে কয়েক এলাকার উস্কে দেওয়া মুসল্লিরা তওবা পড়ানোর নাম করে ২৮ লালন ভক্ত বাউলকে ধরে নিয়ে এলোমেলো করে চুল দাড়ি কেটে দেয়। যশোরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাউল শিল্পীকে।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়ায় হামলার দৃশ্যও আমরা দেখেছি। এসব প্রত্যেক ঘটনার প্রতিবাদেই রাস্তায় নেমে এসেছে আমাদের সংস্কৃতিমনা প্রগতিশীল সমাজ। প্রতিবাদ করেছে, ক্ষোভ জানিয়েছে কিন্তু সেই ক্ষোভ আর প্রতিবাদ কখনোই রাষ্ট্রযন্ত্রের দৃষ্টিগোচর হয়নি। বরং কিছুদিন আগেই ধর্ম অবমাননার অজুহাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল টাঙ্গাইলের বাউল শিল্পী শরিয়ত বয়াতিকে।

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময় অবশ্য সংসদে বলেছিলেন, বাউল ঐতিহ্য যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। চুল কাটা বা বাউলদের প্রতি যেকোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য নয় বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কথার জায়গায় কথা থাকে কাজের বেলায় উল্টো। বাউলরাও একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তারা প্রগতিশীল ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কার থেকে অনেক দূরে তাই কোনো প্রচলিত ধর্মেই তাদের স্থান হয়নি। বাউলদের ভাবতত্ত্ব গান অনেক সময় ধর্মীয় গোঁড়ামির মুখোশ উন্মোচন করতে সার্থক বলেই মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার আমাদের বাউল সম্প্রদায়। ফকির লালন সাঁই বলেছিলেন, সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে, লালন কয় জাতের কী রূপ আমি দেখলাম না দুই নজরে।

তাই তো আমরা দেখেছি উগ্রবাদীরা বিনা বাধায় বিমানবন্দরের প্রবেশপথের লালন ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছিল। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা উল্লেখ থাকলেও তা শুধুই কাগজে কলমে। তাই যদি না হত এত অঘটনের পরও কীভাবে একজন বাউল শিল্পীর চিরকালের আশা আকাক্সক্ষা জ্বালিয়ে ছাই করে দিতে পারে? এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে আমরা দেখেছি উগ্রবাদীদের নারকীয় তা-ব। পবিত্র ধর্মগ্রন্থও তাদের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। ধর্ম রক্ষার নাম করে তারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে আগুনে পোড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, যারা নিজেদের হীন স্বার্থহীন মতবাদ রক্ষায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থে আগুন দিতে পারে তাদের কাছে বাউল রণেশ ঠাকুরের গানের ঘরে আগুন দেওয়া তো সাধারণ ব্যাপার। আমরা সৃষ্টির সেরা প্রাণী হিসেবে আল্লাহ আমাদের এই দুনিয়ার প্রেরণ করেছেন। এটাই আমাদের আসল পরিচয়। তারপরও আমরা নানা ভাগে বিভক্ত। কেউ কারো মতবাদ বা বিশ্বাসের ভিন্নতা পোষণ করলে চলে চাপাতির কোপ। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন কেন বারবার আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি? ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আজও সত্যিকারের মানবিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দীর পর এসেও প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনায় গড়ে তুলতে ব্যর্থ। এর জন্য তথাকথিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নির্লজ্জ ক্ষমতার লোভ ক্ষমতার স্বার্থে বারবার ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাতই মূল কারণ।

যদি আমাদের দেশকে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তা হলে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেদিন ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা করতেও কেউ আর সাহস পাবে না। রণেশ ঠাকুরদের স্বপ্নে আর কেউ আগুন দিতে সাহস পাবে না।

ওয়াসিম ফারুক : কলাম লেখক

[email protected]

 
Electronic Paper