ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় প্রস্তুতি কী

এম এ খালেক
🕐 ১২:১৩ অপরাহ্ণ, মে ১৯, ২০২০

অর্থনীতি শাস্ত্রে ‘কনজুমার্স সারপ্লাস বা ভোক্তার উদ্বৃত্ত’ বলে একটি সূত্র আছে। একজন ভোক্তা নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা সেবা ক্রয়ের জন্য যে অর্থ খরচ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। বাজারে গিয়ে যদি তার চেয়ে কম মূল্যে জিনিসটি ক্রয় করতে পারেন তাহলে যে আত্মতৃপ্তি বা সন্তুষ্টি অর্জন করেন সেটাই ভোক্তার উদ্বৃত্ত বা কনজুমার্স সারপ্লাস। ভোক্তার উদ্বৃত্ত অবস্থায় প্রায়শই একজন ক্রেতা তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে উদ্যোগী হন। কারণ তার মনে একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে তিনি পণ্যটি কিনে লাভবান হয়েছেন। আগামীতে এই অবস্থায় বর্ণিত পণ্যটি কিনতে নাও পাওয়া যেতে পারে। তিনি অন্যদেরও পণ্যটি ক্রয় করতে উৎসাহিত করতে পারেন। অবশ্য সবক্ষেত্রে যে এমনটি ঘটবেই তা নাও হতে পারে। কিন্তু ভোক্তা নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য ক্রয়ের জন্য যে অর্থ ব্যয় করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন বাজারে গিয়ে প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্যটি ক্রয় করতে হলে যে কষ্ট অনুভব করেন তাকে অর্থনীতির পরিভাষায় কী বলে আখ্যায়িত করা হয় তা পরিষ্কার নয়। যিনি বা যারা ভোক্তার উদ্বৃত্ত থিউরির উদ্ভাবক তাদের দেশে হয়ত অধিকাংশ জিনিসই প্রত্যাশার চেয়ে কম মূল্যে পাওয়া যেত।

তাই তারা বাজারে গিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য ক্রয়ের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব দেননি বা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। বাজারে গিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে কম ব্যয় পণ্য ক্রয় করতে পারাকে যদি ভোক্তার উদ্বৃত্ত বা কনজুমার্স সারপ্লাস বলা হয় তাহলে বাজারে গিয়ে প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য ক্রয় করার অবস্থাকে কনজুমার্স ডেফিসিট বা ভোক্তার ঘাটতি বলা যেতে পারে। আমাদের দেশের অর্থনীতি এমনই যে এখানে ভোক্তাদের প্রতিনিয়তই প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য ক্রয় করে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়। ফলে কনজুমার্স সারপ্লাস বা ভোক্তার উদ্বৃত্তের সুখস্মৃতি লাভ করা তার পক্ষে প্রায়শই সম্ভব হয় না। বিশেষ করে জাতীয় দুর্যোগের সময় ব্যবসায়ীদের অনেকেই পরিকল্পিতভাবে পণ্য ও সেবা মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। এতে নির্দিষ্ট আয়ের খেটেখাওয়া মানুষগুলোকে মারাত্মক দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানবতাবিবর্জিত ব্যবসায়ী আছেন যারা সুযোগ পেলেই পণ্য মূল্য বৃদ্ধি করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিতে পারঙ্গম। 

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চলছে। এটা কতদিন স্থায়ী হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনাভাইরাস কখনই সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা যাবে না। অর্থাৎ আমাদের করোনাভাইরাসের মাঝেই দিনযাপন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই সতর্ক বাণী নিশ্চিতভাবেই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। শুধু উন্নয়নশীল দেশই বা বলি কেন পুরো বিশ্বে র জন্যই উদ্বেগ-আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববাসী আর কখনই এমন ভয়াবহ এবং সর্বগ্রাসী প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেনি।

সাধারণত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হলে তা একটি নির্দিষ্ট দেশ বা এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে দুর্যোগে বিপর্যস্ত নয় এমন সব দেশ সংশ্লিষ্ট দুর্যোগগ্রস্ত দেশকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ^ই বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় বিশে^র অধিকাংশ দেশই সাহায্যদাতা নয়, সাহায্যগ্রহীতার পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাই কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না।

আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংক্রমণের অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করি তাহলে ভয়াবহ চিত্রই প্রত্যক্ষ করবো। ইতোপূর্বে এক লেখায় পণ্য ও জনশক্তি রপ্তানি খাতের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান এই দু’টি খাত আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। এর অনিবার্য ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকুচিত হয়ে আসতে বাধ্য। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণ করে চলছিল। সেখানে ভাটার টান পড়বে। এই অবস্থায় স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার প্রভাবিত হবে।

ইতোপূর্বে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন এবং অতিমূল্যায়ন ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে মার্কিন ডলার ছেড়ে অথবা বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আগামীতে এটা করা সম্ভব নাও হতে পারে। নিকট ভবিষ্যতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার অবমূল্যায়ন অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ মার্কিন ডলার আয়ের রাস্তা রুদ্ধ হলে বাজারে মার্কিন ডলারের ক্রাইসিস সৃষ্টি হবে। সেই অবস্থায় বিনিময় হার যদি বাজার চাহিদা এবং জোগানের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।

স্থানীয় ভোক্তারা এখন কনজুমার্স সারপ্লাস অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছেন। বাজারে গিয়ে অধিকাংশ পণ্য, যা পচনশীল তা কাক্সিক্ষত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের উৎপাদকগণ তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সঠিক মূল্যে বিক্রি করতে পারছে না। কথায় বলে, ‘প্রয়োজন মানে না রীত।’ আমাদের দেশের তৃণমূল পর্যায়ের উৎপাদক শ্রেণি বরাবরই অত্যন্ত দুর্বল। তারা বার্গেনিং করার ক্ষমতা রাখেন না। মধ্যস্বত্ব ভোগীরা এই সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু এবার ঘটেছে অন্য ঘটনা।

পরিবহন সঙ্কটের কারণে তৃণমূল পর্যায়ের উৎপাদকগণ তাদের পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারছেন না। ফলে পানির দরে তাদের কষ্টার্জিত পণ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনো কোনো এলাকায় দুধের মূল্যের চেয়ে পানির দাম বেশি বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। মৌসুমি ফল চাষিরা উৎপাদিত আম-লিচু ইত্যাদি বাগান থেকে তুলছেন না। উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায়। যেহেতু তৃণমূল পর্যায়ের উৎপাদকগণ তাদের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ করার মতো কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না তাই তারা এগুলো বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে আমরা এখন বাজারে গিয়ে কাক্সিক্ষত মূল্যের চেয়ে কম দামে এসব পণ্য কিনতে পারছি। কিন্তু কিছু দিন পর কী অবস্থা হবে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? আগামীতে বাজারে গিয়ে কিছু কিছু পণ্য আছে যা অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য দিলেও পাওয়া যাবে না। আবার কিছু কিছু পণ্য বাজারে পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও মানুষ ক্রয়ক্ষমতার অভাবে তা ক্রয় করতে পারবেন না। উৎপাদন শ্রেণি তাদের পণ্য স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু ভোক্তাগণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে ইচ্ছা থাকলেও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারবেন না। মানুষের হাতে নগদ অর্থ থাকাটা খুবই জরুরি। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ না থাকলে নানা ধরনের সামাজিক অনাচার দেখা দিতে পারে। কথায় বলে, ‘ক্ষুধার্ত মানুষের নিকট থেকে দীর্ঘমেয়াদি নৈতিকতা আশা করা যায় না।’

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনাভাইরাসে বিশ^ব্যাপী যে আর্থিক ক্ষতি হবে তার সম্ভাব্য পরিমাণ ৯ ট্রিলিয়ন (৯ লাখ কোটি) মার্কিন ডলার অতিক্রম করে যেতে পারে। আর্থিক ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর। অথচ আর্থিক ক্ষতির অভিঘাত কাটিয়ে উঠার ক্ষমতা এসব দেশেরই সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করার কথা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অর্জন। কিন্তু করোনাভাইরাসের অভিঘাত যদি আমরা মোকাবেলা করতে না পারি তাহলে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের ইস্যুটি দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে পারে।

উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে অনেক দেশই প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা এই অর্জন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, নেপাল। কয়েক বছর আগে নেপাল প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছিল। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে তারা সেই সুযোগ হারিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতে পারে। বিশ^ পর্যটন সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছে, যে আর্থিক খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে তা হচ্ছে পর্যটন শিল্প। ইতোমধ্যেই এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত ৫ কোটি মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছেন। হোটেল ব্যবসায়ের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। পরোক্ষ ক্ষতির কথা বিবেচনা করলে এই খাতে অন্তত ৫০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প কার্যত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবে পর্যটনমুখী নয়। অনেকেই এখনো পর্যটনকে অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা বলে মনে করেন। বাংলাদেশের পর্যটন মৌসুম হচ্ছে মূলত সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু এবার পর্যটন মৌসুমের শেষ লগ্নে এসে সংক্রমণ ঘটে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট হোটেল ব্যবসায় এবার বিপর্যস্ত হয়েছে। অনেক হোটেল মালিক কর্মচারী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন।

সরকার নানাভাবে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে চাইছে বা করছে। খাদ্যদ্রব্য সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে সরাসরি নগদ অর্থ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হবে। সম্ভব হলে মৌসুমি ফল এবং অন্যান্য ফসল সরকারি উদ্যোগে ক্রয় করে তা বিতরণ এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক অবস্থায় আম-লিচু ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে তারা যেন উপযুক্ত মূল্যে কৃষকের নিকট থেকে ক্রয় করে তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ইতোমধ্যেই ত্রাণের চাল, চিনি, তেল চুরির অভিযোগে অন্তত ৫০ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু শুধু বরখাস্ত করলেই হবে না। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে হলেও এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper