ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তবুও মানব থেকে যায়

স্বপন নাথ
🕐 ১১:০১ পূর্বাহ্ণ, মে ১৮, ২০২০

আলেকজান্ডার তার জীবনের শেষ সময়ে কিছু কথা বলেছিলেন, যা মিথের মতো এখনও বহমান। মারা যাওয়ার আগে তার সেনাপতিদের কাছে তিনি তিনটি ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। সেগুলো হলো- ১. মারা যাওয়ার পর যেন চিকিৎসকরা আমার কফিন বহন করে। ২. সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়ার পথে যেন আমার সঞ্চিত সম্পদ, সোনা-দানা ছড়িয়ে ফেলা হয়। ৩. সমাধির দিকে যাওয়ার সময় আমার হাত দুটি যেন কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এমন অদ্ভুত ইচ্ছে শুনে সেনাপতিদের মনে এর কারণ জানার ইচ্ছে হলো। কিন্তু আলেকজান্ডারকে কেউ সাহসে জিজ্ঞেস করছিল না। এর মাঝে একজন জানতে চাইল এমন ইচ্ছে প্রকাশের কারণ কী। আলেকজান্ডার উত্তরে বলেন, আমার এই তিনটি ইচ্ছের মাধ্যমে দুনিয়াতে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। প্রথম ইচ্ছে থেকে লোকে বুঝতে পারবে, চিকিৎসকরা আসলে অসুস্থ কাউকে সারিয়ে তুলতে পারে না। অবধারিত মৃত্যুর কাছে সবাই খুব অসহায়। দ্বিতীয় ইচ্ছে থেকে তারা জানবে, আমার অর্জিত সম্পদ, সোনা-দানা যাওয়ার বেলা আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি না। যে সম্পদের জন্য সারা জীবন ব্যয় করেছি। তা মূলত অপচয় মাত্র। আর তৃতীয় বিষয়ে জানা যাবে, আমি পৃথিবীতে শূন্য হাতে এসেছিলাম, আবার শূন্য হাতে বিদায় নিচ্ছি।

আমরা পাঠক হিসেবে নানা তথ্য থেকে জেনে নিই, আলেকজান্ডার ছাড়া আরও অনেকে মৃত্যুর আগে নানা ধরনের কথা বলেছেন। যা উত্তরকালের জন্য অবশ্যই শিক্ষণীয়। যা কিছু হোক এসব শিক্ষা প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় দুটোই হতে পারে। তারপরও মানুষের মধ্যে সাধারণত কোনো বোধের প্রতিফলন দেখা যায় না। তবে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ, মহামারি ও দুর্যোগে মানুষ বিভিন্ন মিথ ও উপকথার জন্ম দিয়েছে। কালে কালে তৈরি হওয়া এসব মিথকথন ও ট্যাবু এখনও সমাজে বহমান। চলমান কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ও মৃত্যুতে সামাজিক ট্যাবুর প্রভাব আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এর আগে পৃথিবীতে যতবার এমন মহামারি এসেছে, ততবারই নতুন নতুন কিসসা-কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত, রোগ, অসুখ ও সংক্রমণ এমনকি দমন-পীড়ন মানবসভ্যতার নিত্যসঙ্গী। শুধু সভ্যতা নয় জীবনের অনুষঙ্গে তাড়া করছে এসব উপাদান। সবসময়ই এসব নিয়ে মানুষের ভাবতে হয়েছে। তবে ভাবনার স্তর সমান নয়। তা ছাড়া সামাজিক কাঠামোবদ্ধতা নানা রকমের ইতি-নেতির জন্ম দিয়েছে, যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। তাহলে অসুস্থতা, মহামারি সভ্যতার নিত্যসঙ্গী বলেই কি আলবেয়ার কামু দ্য প্লেগ উপন্যাসে এমন সংক্রমণ-আবর্তের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন? আমরা কামুর মন্তব্য বিবেচনায় নিতেই পারি। তার এ উপন্যাসে শেষের কয়েকটি কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। রোগের জীবাণু ভ্রমণ করতে করতে আমাদের ঘরের নানা জায়গায় আশ্রিত হয়ে ওঠে। তা ক্রমেই আবার সক্রিয় শক্তিতে আবির্ভূত হয়। ডা. রিও-এর মাধ্যমে দ্য প্লেগ উপন্যাসে এ বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে- 

He knew what those jubilant crowds did not know but could have learned from books: that the plague bacillus never dies or disappears for good; that it can lie dormant for years and years in furniture and linen-chests; that it bides its time in bedrooms, cellars, trunks and bookshelves; and that perhaps the day would come when, for the bane and the enlightening of men, it would rouse up its rats again and send them forth to die in a happy city.

কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে বিশ্বে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল আমরা লক্ষ করেছি। মানুষ হিসেবে কেউই এত মৃত্যু দেখে স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। ফলে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে মানুষ বিপর্যস্ত, দ্বিধান্বিত। এখন এক অজানা অনিশ্চিত শঙ্কায় প্রতিদিন যাপন করছে মানুষ। নিকট ইতিহাসে এত মৃত্যু মানুষ দেখেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক মানুষের মৃত্যুর পর ২০২০ সালে পুনরায় এমন ভয়াবহ মৃত্যুর সাক্ষী হতে হলো। একই দিনে বিশেষত ইতালি, স্পেন, জার্মানি, আমেরিকাতে করোনাভাইরাস আক্রমণে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। এত মৃত্যু দেখে সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স আত্মহত্যা করেছেন।

এমন খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা হিসেবে সংবাদ পাঠ করতে বা শুনতে হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি। এখন এসব মৃত্যু শুধু সংখ্যা, মানুষ নয়। বাস্তবে খুবই কঠিন কাজ হলো, মৃত্যুর প্রতিবেদন তৈরি ও গণমাধ্যমে প্রতিদিন খবরগুলো পাঠ করা। বাইরে থেকে আমরা যারা শ্রোতা তারাই নিজেকে সামলাতে পারি না। বাস্তবতায় উপস্থিত থাকা যে কত বেদনার তা ওই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না। প্রতিদিন কঠিন সত্যের মুখোমুখি হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।

আমরা তাও জানি যে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা, নানা অসুখ, আত্মহত্যা, খুন-খারাবি, মারামারি, সংঘাত ও যুদ্ধে প্রচুর মানুষ ও প্রাণী মারা যায়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে উল্লেখিত কারণসমূহে মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যুর হার কমে গেছে। বরং প্রকৃতি ও প্রাণিজগৎ তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। শুধু মানুষের নিয়ন্ত্রণে, পোষ্য ও কাছাকাছি থাকা প্রাণীগুলো কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে। বন্যপ্রাণীরা এখন উৎপাতবিহীন বেশ ভালোই আছে। সামুদ্রিক প্রাণিকুল এখন দূষণমুক্ত পরিবেশে আনন্দে সাঁতার দিচ্ছে ও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমরা কাছাকাছি পাখিদের ভিড়, ওড়াওড়ি দেখে বুঝতে পারি এসময় তারা কত আমোদে পার করছে। বৃক্ষরাজি, লতাপাতা এখন বাড়ন্ত। বনজ, জলজ স্থানগুলোতে এখন কেউ অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে পারছে না। প্রকৃতিতে বিপরীত, তবে অসামান্য সৌন্দর্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মানে হলো এ জগৎ, পৃথিবী শুধু মানুষের নয়। এটি নির্জলা সত্য, করোনা সংক্রমণের মহামারিতে আবার শিক্ষা নিতে হলো। প্রাণিজগতের আনন্দ ও স্বাধীন চলাফেরা কীসের ইংগিত বহন করে? এতে পরিষ্কার, মানবসমাজ তার সীমানা লঙ্ঘন করেছে। এর প্রমাণও বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। আমরা সাধারণ জ্ঞানেই তা উপলব্ধি করছি।

প্রকৃতির বিশুদ্ধতা, দূষণ কমে যাওয়া, আলোবাতাসে শ্বসন প্রক্রিয়ার স্বাচ্ছন্দ্য প্রমাণ করে, পরিবেশ দূষণ চলছে মারাত্মকভাবে। কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত কপ (COP) সম্মেলনেও সজোরে উচ্চারিত হচ্ছে পরিবেশ রক্ষার কথা। কে শোনে কার কথা। এবার কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর যুক্তি দিয়ে বলতে হয় না যে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও দখল করা যাবে না। কোনো না কোনোভাবে এর প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা আছে।

অন্যদিকে মারণাস্ত্র শক্তির অশেষ ক্ষমতাও এক্ষেত্রে যে বিকল তা কি আর বলতে হয়। সকল অস্ত্র, কূটনীতিবিদ্যা, হিংসা, রক্তপাত এক ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাই হলো এখন নিয়ামক বিষয়।
চলবে...

স্বপন নাথ : উপ-পরিচালক, নায়েম, ঢাকা
[email protected]

 
Electronic Paper