ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মারাত্মক সংকটে শিক্ষাব্যবস্থা

মোহাম্মদ নজাবত আলী
🕐 ১:৫৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৫, ২০২০

সংবিধানে উল্লেখ আছে, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। একই সঙ্গে জন্মগত অধিকার। শিক্ষা শুধু অধিকারই নয়, জাতি গঠনের মূল স্তম্ভও বটে। এই শিক্ষা লাভে কেউ কাউকে বাধা প্রদান করতে পারে না তেমনি শিক্ষা কেউ কেড়ে নিতেও পারে না। কিন্তু করোনা ভাইরাস শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সাময়িকভাবে হলেও শিক্ষা কেড়ে নিয়েছে। মরণব্যাধি করোনার ভয়াবহ ছোবল থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় গত ১৮ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। সঙ্গত কারণে দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এক চরম সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ-শত বছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগোচ্ছে, এগিয়ে যাক। তাই আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের যে কয়েকটি আমাকে আশাবাদী করে তার মধ্যে পড়ালেখার প্রতি আমাদের দরিদ্র মানুষের প্রবল আগ্রহ। আমি গ্রামে বাস করি।

এলাকার অনেক মানুষের সঙ্গে আমার চেনা, জানা-শোনা। তাদের মধ্যে দরিদ্র মানুষ তার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েছে পড়ালেখার জন্য। তাদের আশা, সন্তান পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হবে। ভ্যান, অটোচালক একজন পিতা তার কষ্টের উপার্জন দিয়ে তার সন্তানকে মানুষ করবে এটাই বড় স্বপ্ন। আবার যখন শহরে যায় তখন রিকশায় চড়ে আলাপচারিতায় জানতে চায় তার ছেলেমেয়ে ক’জন তারা কী করছে ইত্যাদি। এ রকম বিভিন্ন সময়ে আমি জেনেছি তারা তাদের সন্তানকেও স্কুলে পাঠিয়েছে। ঘরে বসে নেই। এই যে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির জীবনসংগ্রামী মানুষগুলোর মনে শিক্ষার প্রতি তীব্র আগ্রহ। বাংলাদেশে পড়ালেখার প্রতি পিতা-মাতা, অভিভাবক ও ছেলেমেয়েদের এই আগ্রহ সৃষ্টিতে শেখ হাসিনা সরকার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য অনুসরণীয়। বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া, উপবৃত্তি, নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত ও ফলপ্রকাশ ইত্যাদি শিক্ষা ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সম্প্রতি ২৭৩০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও প্রদান এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়গুলো অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের আশান্বিত করে। কিন্তু করোনা আমাদের সন্তানদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করেছে। তবে এই সংকট থাকবে না। সবকিছুই আগের মত স্বাভাবিক গতিতে চলবে।

ছোটবেলায় বাবা-মা দাদা-দাদির মুখে কলেরা বসন্তের কথা শুনেছি। সে সময় মানুষ ভয়ে এতটা তটস্থ ছিল, কেউ ঘর থেকে বের হতো না। উঠতি বয়সের বিশেষ করে মেয়েদের অন্য গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে পাঠিয়ে দিতেন। কালের প্রবাহে সময়ের পরিবর্তনে ওষুধ আবিষ্কারের ফলে সে কলেরা বা বসন্ত এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু বর্তমান করোনা ভাইরাস সেই কলেরার অবয়বে মানুষকে কি আক্রান্ত করছে! করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সাড়া বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ মারাও যাচ্ছে। যার কারণে থমকে গেছে পৃথিবী থমকে গেছে মানুষ। আমাদের যাপিত জীবন থেকে সর্বত্র যেন এক ধরনের অসাড়তা। বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক লেনদেন শিক্ষাব্যবস্থাসহ এককথায় সবকিছু যেন থমকে গেছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবন আজ চরম সংকটে পড়েছে। করোনার কারণে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ১৫ থেকে ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। অন্যদিকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও এইচএসসি পরীক্ষা শুরুও বিলম্বে হবে। তবে সরকার বিকল্প হিসেবে সংসদ টিভি চালু করেছেন। শুধু টিভিতে ক্লাস দিয়ে লাখো শিক্ষার্থী কতটা উপকৃত হবে তা যেমন প্রশ্নসাপেক্ষ তেমনি এ করোনা পরিস্থিতি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা এক অচলাবস্থার মধ্যে পড়বে। একাদশের বার্ষিক পরীক্ষা ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরো পিছিয়ে যেতে পারে।

‘আমার ঘর আমার স্কুল’ নামে সংসদ বাংলাদেশ যে শ্রেণি পাঠদান কর্মসূচি শুরু করেছে তাতে শহর এলাকায় শিক্ষার্থীরা উপকৃত হলেও গ্রামাঞ্চলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে জটিলতার মুখে পড়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষা কার্যক্রম।

শিক্ষাবোর্ডগুলোর এক সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে জটিলতায় পড়েছে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের কার্যক্রম। কারণ সারা দেশে খাতা বিতরণ ও সংগ্রহসহ ফল প্রকাশের যাবতীয় কার্যক্রম আটকে গেছে।

মে মাসের ১ম সপ্তাহে মাধ্যমিক ও সমমানের ফল প্রকাশ হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওএমআর শিট দেখা স্থগিত করেছে শিক্ষাবোর্ডগুলো। এছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকায় লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের পর তা বোর্ডে ফেরত দিতে পারছেন না অনেক পরীক্ষকরা। অথচ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা বাংলাদেশ আক্রান্ত না হলে যথাসময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকত। কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। আগামী ৭ থেকে ৯ মে’র মধ্যে পাবলিক পরীক্ষার (এসএসসি ও সমমান) ফল প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তা পিছিয়ে যেতে পারে। যদি এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ পিছিয়েই যায়, তাহলে উচ্চ মাধ্যমিকের ভর্তি পরীক্ষাও পিছিয়ে যাবে। যেকোনো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম একটির সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় থাকে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ একটি শ্রেণির সঙ্গে পরবর্তী আরেকটি শ্রেণির সমন্বয় রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, প্রাথমিকের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা বা এসএসসির ফল প্রকাশ বা এইচএসসি পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত না হলে পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হবে। তাই অনেক শিক্ষাবিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ১৫ এপ্রিলের মধ্যে যদি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা না যায় তাহলে পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রমও পিছিয়ে যাবে। সুতরাং করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে মানুষ মারা যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি চরম ঝুঁকির মধ্যে যেমন ফেলে দিচ্ছে তেমনি চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এলামেলো হয়ে যাচ্ছে। কোনো অঘটনে সাজানো গোছানো পরিবার যেমন তছনছ হয়ে যায় তেমনি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

বিগত ১০ বছর ধরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী চলা শিক্ষাব্যবস্থা এক করোনার কারণে যেন থমকে গেছে। পাবলিক পরীক্ষার সঙ্গে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাও ঠিক সময় নাও হতে পারে। একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ৩০ এপ্রিল থেকে ১০ মে’র মধ্যে এবং নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা জুন মাসে যথারীতি হয়ে থাকে। কিন্তু যথাসময়ে তা অনুষ্ঠিত হবে কিনা এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। উপরোন্ত পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতরসহ অন্য আরও কিছু ছুটি মিলিয়ে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছুটি থাকবে। এছাড়াও চলতি এপ্রিল মাসে পবিত্র শবে বরাত, ইস্টার সানডে ও পহেলা বৈশাখের ছুটি রয়েছে।

তাছাড়া সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটি বাদে ১১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১১ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা। তাই ১২ এপ্রিল থেকে ক্লাস শুরু হলেও ইতোমধ্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থার এ সংকটের মুখে সিলেবাস এখনো শেষ হয়নি। তাই পরীক্ষার প্রশ্নগুলো অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ করার দাবি জানিয়েছেন অনেক অভিভাবক।

আমাদের দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের খবর আসে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমদিকে। তখন থেকেই অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দেয়। তবুও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি যখন ক্রমশ জটিল হয় এবং তার ঢেউ বাংলাদেশে লাগে তখন সরকার গত ১৮ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সে থেকে লাখ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা দেয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে একথা যেমন সত্য তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। গ্রাম-গঞ্জের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা অযথা ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠে। তবে করোনার কারণে তারা কিছুটা হলেও ঘরের মধ্যেই থাকছে কিন্তু নিয়মমত পড়াশোনা করছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, পড়াশোনার গতি কমে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, কোচিং বন্ধ যার কারণে পড়াশোনায় মন বসছে না। তবে একেবারেই পড়ি না তা নয়, পড়ি।

পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। শহরে অবশ্য এ ধরনের পরিবেশ নেই। অভিভাবকরা সচেতন। বন্ধের মধ্যে তারা ঠিকই লেখাপড়া করে। সময়ের সদ্ব্যবহার করে। তবে গ্রাম-গঞ্জের মেধাবী ছেলেমেয়েরা ঠিকই পড়ালেখা করে। শহর ও গ্রামের মধ্যে পরিবেশগত পার্থক্য থাকলেও আজকাল গ্রামের ছেলেমেয়েরাও পরীক্ষায় ভাল ফল করছে।

তাই এ সংকটকালে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, দৃষ্টি, মনোযোগ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের শক্তি, বলে, আত্মবিশ্বাসী হও এ সংকট কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তবে অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। একটু পরিশ্রম করো, মনোযোগী হও, পড়ার টেবিলে বসো দেখবে মনের অসাড়তা কেটে গেছে। করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা যে স্থবির হয়ে পড়েছে তা পুষিয়ে নিতে হবে শিক্ষার্থীদেরই। এর ব্যতিক্রম হলে শিক্ষার্থীরা অনেকেই বিপাকে পড়তে পারে। সরকার তো চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। এ সংকট বাংলাদেশের একার নয়, বিশ্ব সংকট। করোনা আমাদের পরিবারের, সমাজের, সরকারের সব পরিকল্পনা থামিয়ে দিয়েছে।

কোনো রোগ-ব্যাধি মহামারি চিরস্থায়ী নয়। করোনাও একদিন থেমে যাবে। তবে কিছু সময় লাগতে পারে। এটি সামগ্রিক দিক থেকে সাময়িকভাবে শিক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করলেও এদেশের শিক্ষাপ্রিয় শিক্ষার্থীরা নিজ দায়িত্বে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ইচ্ছাই বড় শক্তি। তাই ইচ্ছা করলে তারা ঘরে বসেই সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।

মোহাম্মদ নজাবত আলী : সহকারী শিক্ষক, চামরুল উচ্চ বিদ্যালয়, দুপচাঁচিয়া, বগুড়া

 
Electronic Paper