ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গুজব নয়, সত্যচর্চা হোক

অলোক আচার্য
🕐 ১:২৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৪, ২০২০

দেশে গুজব শব্দটি নানা কারণে একটি আলোচিত বিষয়। আমরা মনে হয় গুজব ছড়াতে এবং তা বিশ্বাস করতে বেশ পছন্দ করি! আগে পিছে ভাবি না। সত্য মিথ্যার ধার ধারি না। আবার গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লুটতেও আমরা ওস্তাদ। এমনকি সারা পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশও করোনার বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তখনো অনেকে গুজব ছড়াতে ব্যস্ত। দেশ যখন ক্রান্তিকাল তখন সবার স্বচ্ছ থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নানা ধরনের গুজব বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যা রীতিমতো বিশ্বাস করাও কষ্টকর সেই গুজবে নানা অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড ঘটছে। মানুষের প্রাণ যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। সেসব গুজবে কান দিয়ে মানুষ ও দেশের ক্ষতি হচ্ছে।

গুজব বলতে সাধারণত বোঝায় কোনো ব্যক্তি, কোনো গোষ্ঠী বা কোনো দলের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক কোনো অপপ্রচার যার পেছনে বেশিরভাগ সময়ই কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। কোনো অসত্য তথ্য বা প্রচার যা কারও ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়ও বিঘ্ন হতে পারে। আমরা খুব সহজেই গুজবে কান দিই। আমাদের শিক্ষা দীক্ষার কোনোকিছুর প্রয়োগ না করেই বিশ্বাস করে নিচ্ছি। কোনোকিছু শুনলেই বিশ্বাস করতে হবে? যেখানে চোখে দেখেও আজকাল বিশ্বাস করাটা বেশ কষ্টকর। সেখানে কারও কাছ থেকে কিছু শুনেই সেটা বিশ্বাস করা এবং তা নিজের মতো প্রচারের কাজে লেগে পড়া! 

চিলে কান নিয়েছে শুনে কান উদ্ধারের জন্য সবাই চিলের পেছনে ছুটি। একবারও নিজের কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করার কথা মনে করি না। আমরা এতটাই নিষ্ঠুর যে কে সত্যিকার অর্থে ছেলেধরা তা বিচার বিবেচনা না করেই পিটিয়ে মেরে ফেলি! গণপিটুনিতে আহত হওয়ার ঘটনা দেশে বেশ কয়েক স্থানে ঘটেছে। কী আশ্চর্য! আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার গুজবে কান দিতে নিষেধ করলেও আমরা তা শুনছি না। কেউ অপরাধী হলে তার জন্য আইন আছে। আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি। আইনের হাতে তুলে দেওয়ার বদলে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো সভ্য জাতির কাজ হতে পারে না।

যদি জানা যায় সে নির্দোষ তবে তাকে কি আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? এটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু না। আমাদের কান গুজবের জন্য খোলা! কাউকে হেয় করার বা কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে।

আজকাল গুজব ছড়াতে ডিজিটাল মাধ্যমই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় গুজব ছড়াতে। কারণ এসব মাধ্যমে কোনো অসত্য তথ্য প্রচার করা দ্রুততর এবং তুলনামূলক গুজব সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সাময়িক নিরাপদে অবস্থান করতে পারে। গুজবের ক্ষেত্র আজকাল বিস্তৃত হয়েছে। রাজনীতি, ধর্মীয়, সামাজিক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানো হয়। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার কাজে লাগিয়ে হীন স্বার্থ উদ্ধার করা। গুজব ক্ষেত্রবিশেষে অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।

গুজবে প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় নিরীহ মানুষও প্রভাবিত হয় এবং নেতিবাচক কার্যে জড়িয়ে পড়ে। আজকাল অনলাইনের যুগে গুজব সৃষ্টি করাটা বেশ সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুলে এসব ভুল তথ্য প্রচার করছে। গুজব প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজও করে যাচ্ছে। গুজবের প্রধান টার্গেট থাকে জনগণের সরলতাকে কাজে লাগানো। কোনো ষড়যন্ত্র যখন ব্যর্থ হয় তখন গুজব ছড়ানো হয়।

আমাদের এই ভারতবর্ষেই গুজব ছড়ানোর অনেক ইতিহাস রয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময়কালে কার্তুজে গরু এবং শূকরের চর্বি ব্যবহারের গুজব তুলে হিন্দু এবং মুসলিম সৈনিকদের উত্তেজিত করে তুলেছিল। এরকমভাবে বহুবার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য গুজবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়ছে। বিভিন্ন সময় গুজবকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিলও করেছে গুজব সৃষ্টিকারীরা। চিলের কান নেওয়ার ছড়াটা আমরা প্রায় সবাই জানি। কানের খোঁজে সেই যে ছুট দিল চিলের পেছনে কিন্তু সেই চিলটাকে আর ধরতে পারল না।

গুজব এরকমই হয়। কোনো গুজবে কান দিয়ে ছুটলে কেবল গুজব সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যই হাসিল হয়, কাজের কাজ কিছু হয় না। আমাদের অদৃশ্য কান মাঝে মধ্যেই চিল নিয়ে ছুট দেয়, আর আমরাও সেই চিলটার পেছনে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে একসময় কানে হাত দিয়ে নিশ্চিত হই যে কান সঙ্গেই আছে। সম্ভব-অসম্ভব, সত্য-মিথ্যা কোনো বিচার বিবেচনা না করেই গুজবের পেছনে ছোটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। গুজব আসলে এক ধরনের বিভ্রান্তি।

গুজবের প্রধান মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। আমাদের সাবধান থাকতে হবে। কর্তৃপক্ষও এসব গুজব সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত যারা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে নিজে থেকেই আমরা সচেতন হতে পারি। একবার দেশের স্বার্থের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলেই সব সম্ভব। যখন আমরা প্রত্যেকেই সমস্যার মুখোমুখি রয়েছি তখন গুজব ছড়িয়ে অন্যকে বিভ্রান্ত করার মতো খারাপ চিন্তা না করে একে অপরকে সাহায্য করার কথা ভাবি। সঠিক তথ্য দিই এবং নিজেও গ্রহণ করি। গুজবে কান না দিয়ে সামনের দিনগুলিতে নিজেদের সচেতন করি।

কোনো গুজব বিশ্বাস করার আগে প্রত্যেকের উচিত সেই ছড়ানো বিভ্রান্তি একবার হলেও ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া। গুজব হয় মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। যার পেছনে ছোটা কেবল সময়ের অপচয়ই নয় বরং থাকে জীবনের ঝুঁকি।

আজকাল ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব সৃষ্টি হচ্ছে খুব বেশি। যেহেতু আমাদের সবার হাতে হাতে এন্ড্রয়েড চালিত মোবাইল ফোন রয়েছে এবং শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাউন্ট রয়েছে। তাই কোনো মিথ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য ছড়িয়ে দিতে বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। খুব দ্রুত একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া একটু সময়ের ব্যাপার।

ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব সৃষ্টিকারীরা প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হয়। তবে এ ধরনের গুজব প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষ এখন আগের চেয়ে অনেক সজাগ রয়েছে। গুজব সৃষ্টিকারীরা কোনোভাবেই যেন বিভ্রান্তি না ছড়ায় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নিজেদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। কোনো অদৃশ্য কানের পেছনে ছোটার আগেই যদি নিজের কানটা একবার দেখে নেওয়া যায় তাহলে গুজবের পেছনে ছোটা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়, কোন দুর্ঘটনা বা জনগণ বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া গুজব থেকে আর কিছু পাওয়া যায় না। তাই গুজবকে ত্যাগ করে সত্যের পথ ধরি।

অলোক আচার্য : শিক্ষক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper