ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচতে হলে মানতে হবে

আশেক মাহমুদ
🕐 ১:২৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৪, ২০২০

করোনা মহামারি এখন বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে নিপতিত। এই মহামারিতে সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। আক্রান্ত প্রায় ২০০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশও দুর্ভাগ্যক্রমে স্থান পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে চিহ্নিত সংক্রমণের চারটি স্তরের মধ্যে আমরা এখন তৃতীয় স্তর বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন স্তরে আছি। চলতি এপ্রিল মাসই হল সবচেয়ে বিপদের সময়। এই সময়ে আমরা যদি সার্বিকভাবে সতর্ক না হই তাহলে আমাদের ভাগ্যে সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায় বা মহামারি হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু ধেয়ে আসবে। সেই জায়গা থেকে লকডাউন কার্যকর করা এবং নিজ নিজ ঘরে বন্দি থাকা আবশ্যক হয়ে গেছে। এই চতুর্থ পর্যায়কে ঠেকানো হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আমরা শুধু হাত-পা মেলে বসে থাকলে করোনা আমাদের ছাড়বে না। আমাদেরও বাঁচতে হবে, অন্যদেরও বাঁচাতে হবে। বাঁচতে হলে জানার সঙ্গে সঙ্গে মানতে হবে।

আকুল আবেদন, সরকারের প্রতি-
১. জানুয়ারির শেষ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ৬৫ হাজার (শেষ দু’সপ্তাতেই পৌনে দু’লাখ) প্রবাসী এদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পূর্ব প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে এবং বিষয়টিকে প্রথমদিকে হালকাভাবে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে প্রবাসীদের রাখা হয়নি। অল্প কিছু বাদে সবাইকে পাঠানো হয় হোম কোয়ারেন্টাইনে, যা আমাদের দেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। তাই প্রবাসী এই মানুষদের হোম কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি থেকে ফিরিয়ে এনে ন্যাশনাল কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে বিমান যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।
২. সরকারি উদ্যোগে সুব্যবস্থার সঙ্গে কোয়ারেন্টাইন সেল বাড়াতে হবে। সরকার টঙ্গী ইজতেমা মাঠে আধুনিক কোয়ারেন্টাইন সেল বানানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। যদিও সরকার দেরি করে ফেলেছে, তথাপি দ্রুততার সঙ্গে চারপাশে উঁচু দেয়াল করে বিজ্ঞানভিত্তিক ও অত্যাধুনিক কোয়ারেন্টাইন সেল চালু করতে হবে।
৩. করোনা ভাইরাস ডিটেকশন করতে জরুরি ভিত্তিতে জঞ-চঈজ নধংবফ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট ও সংশ্লিষ্ট চঈজ ঘঁপষবরপ অপরফ ঃবংঃং-এর জন্য পর্যাপ্ত কিট আমদানি করতে হবে। তার আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত জধঢ়রফ নষড়ঃ টেস্টের ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে। উচ্চমানের টেস্ট কিটের সংগ্রহ বাড়িয়ে, প্রতি থানায় থানায় ল্যাব টেস্টের ব্যবস্থা করে, কয়েকটা করোনা হাসপাতাল বানিয়ে ও সকল ডাক্তার ও নার্সদের জন্য পিপিই সামগ্রীর ব্যবস্থা করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্ত করতে হবে।
৪. সারা দেশে আন্তঃজেলা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ রাখার সীমা বাড়াতে হবে। প্রচারণার নামে যে কোনো জনসমাগম বন্ধ করতে সারা দেশে জরুরি কারফিউ জারি করতে হবে। কেননা ইতালি প্রথমে এটিকে হালকা করে নিয়েছে বলেই সেখানে মহামারি হয়ে গেছে।
৫. যেখানে সেখানে লোকজন যেন জমায়েত হতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টহল দিতে হবে, জমায়েত দেখলেই জরিমানা ও জেলের হুমকিতে রাখতে হবে।
৬. মসজিদ, মন্দিরগুলোকে নোটিস জারি করে বন্ধ করতে হবে। কেউ না মানলে সে ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করতে হবে।
৭. অভাবি ও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য ত্রাণ ও আর্থিক প্রণোদনার আকার বাড়াতে হবে। জেলা প্রশাসন, এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যানের মাধ্যম পরিহার করে সরকারি এই সাহায্য যদি সেনা ও নৌবাহিনীর মাধ্যমে বণ্টন করা হয় তাহলে ওদের ঘরে ধরে রাখার সম্ভাবনা বাড়বে।

প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিÑ
১. গার্মেন্টসসহ সকল কল কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তারা ঝুঁকির মধ্যে। ওদের বেতনভিত্তিক সাময়িক ছুটি দিতে হবে। বৈশ্বিক বাজারে মন্দা পরিস্থিতির কারণে প্রাইভেট মালিকরা দুশ্চিন্তায় আছে। সে কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি সহযোগিতা নিয়ে শ্রমিকদের বেতনভিত্তিক ছুটি কার্যকর করতে হবে।
২. বাজার ব্যবস্থাকে সংকুচিত করতে বাজার মালিক সমিতিকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নিত্যদ্রব্য ছাড়া সব কিছু বন্ধ করতে হবে। তা না হয় বাজার ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে।
৩. নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো বন্ধ করতে প্রাইভেট পাবলিক সমন্বয় দরকার। এ সময় পণ্যের দাম বাড়লে স্বল্প আয়ের মানুষরা তীব্র সংকটে পড়বে, ফলে ক্রাইম বেড়ে যাবে। এ ব্যাপারে সরকারি কড়া পদক্ষেপ দরকার।
৪. যেসব এনজিও এদেশে গরিবদের ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে কাজ করে আসছিল, তাদের গরিবদের জরুরি সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সব কিছু করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায়।
৫. এদেশে যেসব বড় বড় কোম্পানি রয়েছে তাদের কাছ থেকে এমনকি ধনী-শ্রেণির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ফান্ড গঠন করা দরকার। সেই ফান্ড চিকিৎসা এবং ত্রাণকাজে ব্যবহার করা দরকার।

সাধারণ জনগণের প্রতিÑ
১. দয়া করে পণ্য মজুদ করবেন না। ভোক্তাদের উচিত কম করে জিনিসপত্র ক্রয় করা, যেন সবাই সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে পারে।
২. মা-বাবা ও অন্যান্য অভিভাবকদের অবশ্যই ঘরের সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্বেচ্ছায় নিজ ঘরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে হবে। যেখানে সেখানে আড্ডাবাজি বন্ধ করতে পরিবারকে আরো যতœশীল হতে হবে।
৩. বেড়ানো বন্ধ করতে হবে, নিরাপদ দূরত্বে হাঁটতে হবে, পরিষ্কার থাকতে হবে সব সময়।
৪. প্রতিটি এলাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজ নিজ দায়িত্বে ফান্ড গঠন করে অভাবীদের পাশে দাঁড়াতে পারে, এ ক্ষেত্রেও সরকারি সহযোগিতা নিতে হবে। তা না হয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
৫. করোনায় মারা গেলে ‘শহীদ’ এ ধরনের প্রচারণা না করে বলা দরকার, যে সকল স্বেচ্ছাসেবী, ডাক্তার ও নার্স করোনা রোগীদের সেবা দেবেন, রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে কাজ করবেন তারা জাতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। যদি তাদের মৃত্যু হয় তা হবে শহীদি মৃত্যু। ফলে ত্যাগ স্পৃহা আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়।
আসুন, আমরা করোনা প্রতিরোধে যা যা করণীয় তা জানি, সঙ্গে সঙ্গে যেন তা মানি। সবাই সবার জন্য দোয়া করে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে পারি। সাময়িক পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে আমরা জাতিগত সংহতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper