শিশুর স্মার্টফোন আসক্তি
হাসানুর রহমান
🕐 ২:০৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৩, ২০২০
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যতের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের হাতে, নিজেদের অজান্তেই আমরা তুলে দিচ্ছি, তাদের ধ্বংসের হাতিয়ার স্মার্টফোন। গবেষকদের মতে, শিশুরা এক মিনিট কথা বললে, তাদের মস্তিষ্ক স্থির হতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। বর্তমানে, অধিকাংশ শিশুই স্মার্টফোনে আসক্ত। এই আসক্তিই পরিবর্তীকালে শিশুকে পৌঁছে দিচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
শিশুরা হল চারা ফুলগাছের মতো, চারাগাছকে যেমন সঠিকভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে তুলতে হয়। তেমনিভাবে শিশুকেও সঠিকভাবে লালন-পালনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ঘটাতে হয়। শিশুর মধ্যে রয়েছে সুপ্ত সম্ভাবনা যা সমাজ ও দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। বর্তমানে বাবা-মা শিশুর কান্না থামানোর হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছেন স্মার্টফোন। শিশু কান্না করলেই বাবা-মা তার কান্না থামানোর জন্য স্মার্টফোন ফোনের ইউটিউবে গিয়ে নানা রকম কার্টুন চালিয়ে দেয়। আবার অনেক বাবা-মা তার শিশুকে তাড়াতাড়ি খাবার খাওয়াতে তার হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিচ্ছে। এভাবেই একটি শিশু আস্তে আস্তে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে অধিকাংশ শিশু মোবাইল ফোনের ভিডিও, গান, নাচ, কার্টুন অথবা ভিডিও গেমসে আসক্ত, যা ভবিষ্যতের জন্য অভিশাপস্বরূপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি শিশুর মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুরা অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে চোখের জ্যোতি নষ্ট হওয়া, কানে কম শোনা, লিউকেমিয়াসহ নানা রকম মারাত্মক মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। নাক, কান ও গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকররূপে চিহ্নিত করা হবে। শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহার সম্পর্কে সানি’স স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ডেভিড কার্পেন্টার বলেছেন, শীঘ্রই আমরা হয়ত একটি মহামারির শিকার হতে পারি এবং সেটি হলো মস্তিষ্ক ক্যান্সার।
অতিরিক্ত স্মার্টফোনের ব্যবহার শিশুদের মস্তিষ্ক ক্যন্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শিশুদের পড়াশোনার ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে মোবাইল ফোন। তারা পড়ালেখা অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে গেমস খেলা, কার্টুন দেখা, চ্যাটিং কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে ব্যয় করছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম। বাংলাদেশের শিশুদের ওপর করা ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে শিশুদের বাড়িতে স্মার্ট ফোন ব্যবহার বাড়ছে। প্রায় ৫০ ভাগ শিশু ল্যাপটপ ব্যবহার করে। স্কুলে ডেস্কটপ ব্যবহারের সংখ্যা আরো বেশি।
ইংল্যান্ডের পাবলিক হেলথ এক গবেষণায় জানিয়েছে, যেসব শিশু কম্পিউটার, টেলিভিশন ও ভিডিও গেমস নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে, তারা হীনমন্যতা ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্তের শিকার হয়। এছাড়াও শিশু-কিশোরদের হতাশা, বিষণ্ণতা ও আনমনা থাকার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে স্মার্টফোনের ভিডিও গেম আসক্তির কারণেই। এই মোবাইল আসক্তি থেকে শিশুদের বের করে আনতে না পারলে তাদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ কোনো ভাবেই ঘটানো সম্ভব হবে না। আর শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ না হলে, জাতির অগ্রগতি থেমে যাবে, জাতি পাবে মেধাশূন্য নেতৃত্ব। তাই শিশুদের স্মার্টফোনে আসক্ত করবেন না।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তার সন্তানদের ১৪ বছরের আগে স্মার্টফোন তো দূরের কথা, কোনো মোবাইল ফোনই কিনে দেননি! সন্তানদের দিনে ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেন না। অথচ আমরা শিশুদের আবদার মেটাতে অথবা বিলাসিতা করে শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছি স্মার্টফোন, আর শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করছে স্মার্টফোনে ভিডিও গেমস খেলে। আপনার শিশুর অভ্যাস বদল করুন, স্মার্টফোন না দিয়ে ঐ সময়টুকু শিশুকে অন্য কোন দিকে মগ্ন রাখার চেষ্টা করুন। শিশুদের হাতে তাদের উপযোগী গল্প, উপন্যাসের বই তুলে দিন। তাদের ছোট থেকেই বই পড়তে অভ্যস্ত করুন। শিশুর জন্য ছোট্ট পরিসরে পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তুলুন। তাদের সময় দিন, তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করুন, মাঝে মধ্যে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যান। শিশুর সারাদিনের পুরো সময়টাকে ভাগ করুন এবং বয়স অনুযায়ী তাকে ব্যস্ত রাখুন বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ আর খেলা দিয়ে। আপনার বাসার আশপাশে খেলার মাঠ থাকলে শিশুকে খেলাধুলায় উৎসাহী করুন, এতে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক উভয় বিকাশের জন্যই উপকারী হবে।
শিশুদের থেকে স্মার্টফোন সব সময় দূরে রাখুন। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তারা আমাদের অনুকরণ করে। তাই তাদের সামনে নিজেরাও অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। প্রতিটি শিশুর প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। নেপোলিয়ান বলেছিলেনÑ তুমি আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।
একজন সুশিক্ষিত মা-ই তার সন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করে গড়ে তুলতে পারে। তাই সকল মাকেই, তার শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য, স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখতে সচেতন হতে হবে। শিশুর কান্না থামাতে বা খাবার খাওয়াতে মোবাইল হাতে দেবেন না। প্রথম প্রথম হয়ত সে কান্নাকাটি করবে, কিন্তু একটা সময় পর ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে। আপনার শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য আপনাকেই সচেতন হতে হবে।
হাসানুর রহমান : শিক্ষার্থী,আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া