ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রবীন্দ্রনাথ ও সাজাদপুরের কৃষককুল

হাসনাত মোবারক
🕐 ২:৪৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০২, ২০২০

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মানবজমিন উপন্যাসে লিখেছেনে, ‘গোটা সাতেক দুধেল গরুর পনের ষোলো সের দুধ দুইয়ে মংলু গয়লা একটা মস্ত অ্যালুমিনিয়ামের ড্রামে ঢেলে দিয়ে যায়।’ একটা যুৎসই উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতার চিত্র উপস্থাপিত হয় বা উপস্থাপন করতে হয়। অর্থাৎ সাহিত্য সমাজ নিরীক্ষণেরও একটা মাধ্যম বটে। তবে সাহিত্যিকদের জ্ঞাতার্থে একটু বলি, শরৎ সাহিত্যে আফিম, গাঁজা, ভাঙপাতা, চরস, তাড়ি এসবের বিস্তর বিবরণ পাই। এর মানে আমরা সহজেই ধরে নিতে পারি ওই সময়ের সমাজের চিত্রটি অমন ছিল। শীর্ষেন্দুর সাতটি গরুর ষোল সের দুধ হয়। এমনটা তার উপন্যাসে লিখে জানিয়েছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার বয়ান লিখেছেন।

এবার আমিও আমার অভিজ্ঞতার বয়ান দিই। আমিও বিশাল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছি। শীর্ষেন্দু যে ধারণা লিখে জানিয়েছেন অমন আনুপাতিক হারে বেশিরভাগ গরু দুধ দিয়ে থাকে। পাবনা-সিরাজগঞ্জে গরুর দুধ বেশি হয়। এ এলাকায় এমনও গরু আছে একটা গরু এক বসনে মানে একবার দোহনেই ২০-৩০ লিটার দুধ হয়। পাবনা শাহজাদপুরের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ একজন রবীন্দ্রনাথের আগমন ঘটেছিল। রানি ভবানীর নিকট জমিদারি কিনেছিলেন তার পূর্বসূরিরা। সেই সূত্রে জমিদারি দেখভাল করতে কবি পাবনা শাহজাদপুরে থেকেছেন। নদীপথে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসরে গতায়ত পথের বর্ণনা পাই বাংলা সাহিত্যের অমর সম্পদ ছিন্নপত্রে। প্রকৃতির বিস্তর বিবরণ রয়েছে সেখানে।

তার্কিকরা হয়ত প্রশ্ন জুড়বেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য কি এ এলাকায় গরুর দুধ বেশি হয়! জি না। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে একেকটা এলাকার অর্থনৈতিক জোন একেকভাবে গড়ে ওঠে। আরও পূর্বের ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়। প্রাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের তাঁতি ও জোয়ালাদের উত্থান পর্ব। পূর্ববাংলার যমুনা নদীর পাড়ে তাঁতি ও জোয়ালার বসতি গড়ে তোলে। যমুনার জলে কাপড়ে রঙ টেকে ভালো। এজন্য তারা এই এলাকাকে বেছে নিয়েছিল। তেমনি শাহজাদপুর উপজেলার হাওর শোভিভ তৃণভূমিতে গরুর আবাদ উপযোগী। উপযোগী আবহাওয়া ও তৃণলতায় বেষ্টিত ভূমিতে কৃষকরা আবহমানকাল থেকে গরু লালনপালন করে আসছে। রবীন্দ্রনাথ কালিগঞ্জে কৃষি ব্যাংক খুলেছিলেন। সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। আরেকটি বিষয় জানানো দরকার। তথ্যটি বোধের গভীরে পৌঁছানো উচিত। বাঙালির একজন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। তিনি সৃজনধারাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বহুমুখী চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছেন কর্মে। কৃষক ও গ্রামীণ উন্নয়নের সূতিকাগার হিসেবে গণ্য করা হয় নোবেলজয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কৃষিব্যাংকসহ সমবায় গ্রামীণ ব্যাংকের স্বপ্নদ্রষ্টাও একজন কবি। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন তখন ড. ইউনূসসহ অন্যরা রবীন্দ্রনাথের প্রতি কিঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন বলে মনে হয় না।

প্রজাবান্ধব রবীন্দ্রনাথ দূরদর্শী অভিজ্ঞতার আলোকে শাহজাদপুরের মানুষের জন্য বিদেশ থেকে উন্নত জাতের গাভী নিয়ে এসেছিলেন। সেই গাভী এ এলাকার কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেন। এতে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের সবচেয় বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় কারখানা শাহজাদপুরের বাঘাবাড়িতে। মিল্কভিটার পশ্চিমপাশে দিগন্ত জোড়া ফসলি মাঠ। আঁকাবাঁকা, চিকন কোথাও প্রশস্ত কোথাও সরু নদী, নালা, খাল বয়ে চলছে। বড়াল নদীর অববাহিকা। মাঠের পরে মাঠ। বিল চলনের উর্বর ভূমি। এই বিস্তীর্ণ মাঠে গজায় সবুজ ঘাস তৃণলতা। অবারিত মাঠে সবুজের সমারোহ। সকালের শিশিরে ভিজিয়ে পা রাখাল বালকেরা দূর বাগানে গরু চরাতে যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাদরে মোড়া এই এলাকা। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ভাষ্যকে ধার নিয়ে যদি বলিÑ ‘হাওরের গল্প শেষ হলেও ডুবিগাঁওয়ের গল্প ফুরোয় না।’ এটা সেই ডুবিগাঁও। যার শরীরজুড়ে ফসল খেলা করে। জলভর্তি মাছ। এদের গল্পের শেষ হবে না। ভাঙাগড়ার ইতিহাসে রয়েছে এরা। ফ্রিজে দুধ রাখা নিয়ে হইচইয়ে আজকে সকালের ঘুম ভেস্তে গিয়েছে। বিছানা ছেড়ে দূর মাঠের পথে পা বাড়ালাম। তখন পুব আকাশে ভোরের আলো ঠেলে বের হচ্ছে তড়িৎবেগে। আহ কী প্রশান্তি! সবুজ বাতাস। কাঁচামিঠা বাতাসে দুলছে ফসলি জমি। পাল বেঁধে গরু যাচ্ছে মাঠে। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন, আমার ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি! নরম ঘাস দুর্বার জীবনলিপিতে এ এলাকার কৃষকের প্রাণবায়ু মিশে আছে।

এই সবুজ ঘাস খেয়ে গাভী অঢেল দুধ দেয়। এই দুধ খেয়ে শহুরে ছেলেরা বড় হয়। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তারপর মন্ত্রী মিনিস্টার হয়। কাঁড়ি কাঁড়ি দুর্নীতির পাহাড় ঠেলে তারা পাওয়ার প্র্যাক্টিসে মেতে ওঠে। বাট এই কৃষককুলের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। আপনারা কয়দিন আগে পত্রিকায় দেখেছেন পাঁচ টাকা লিটার দুধ বিক্রির হিড়িক পড়েছে শাহজাদপুরে। বিশ্বের মতো মহামারির মাতম বাংলাদেশের বুকেও ছড়িয়ে পড়ছে। দেশ অঘোষিতভাবে লকডাউনে আছে। দুধ কাঁচা তরলজাত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। যোগাযোগব্যবস্থার বন্ধের দরুন এই এলাকার কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। মানুষের পেটে ক্ষুধা লাগলে চোখ-মুখ বুজে সহ্য করতে পারে। পেটে ভেজা গামছা দিয়ে থাকে। এমনও অভাবের দিন গিয়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে। গরুর ক্ষুধা লাগলে হাম্বা হাম্বা স্বরের প্রকোপে জমিন কেঁপে কেঁপে ওঠে। একবার কৃষকদের মনোবেদনাটি বুঝে ওঠার চেষ্টাটুকু এই দেশের কয়জনইবা করে।

মহামারির করোনা ক্রান্তিলগ্নে দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাব। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রভাব পড়ছে। সেটা স্বীকার না করলে কিছু যায় আসে না। বাস্তবতা ভিন্ন। ক্ষুধা এক সচিত্র প্রতিবেদন। সবার ওপরে ক্ষুধা সত্য। আজ জেঁকে বসেছে গরিবগুর্বাদের পেটে ধ্রুব সত্যরূপে। সেটা কিছুটা অনুমান করতে পেরেছে দেশের মানুষ। অন্যান্য পেশার মানুষ, টাউট-বাটপাররা মানুষের ঘাট কেটে, পকেট কেটে সবকিছু পুষিয়ে নেবে একদিন। এই যে পাঁচ টাকা সের দুধ বিক্রি করা কৃষকরা কোনো দিন তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেনি। গরুর পেটে খাবার পড়লে দুধ হয়। প্রত্যেক গরু চাষি মহাজনদের নিকট খৈল, ভূষি, খড়সহ গোখাদ্যের জন্য ঋণ নেওয়া আছে। জোতদারদের জমি বর্গা নেওয়া আছে।
গরুর দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে এসব পরিশোধ করবে একদিন। এমন স্বপ্নই ছিল। মানুষ আশায় বাঁচে। এমন অনিশ্চিত বাজারে কৃষকরা বিপাক থেকে আর উঠতে পারবে না। খোঁজ নিয়ে দেখুন কেমন আছে তারা। এর আগেও এরা প্রতিবাদস্বরূপ রাস্তায় দুধ ঢেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তো শেষ সমাধান নয়। কৃষকদের এমন দুরবস্থায় ওত পেতে আছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

নিকট অতীতে দেখেছি কৃষকদের ধানের দাম নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের খপ্পর ও কারসাজিতে কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না। অথচ ওই সিন্ডিকেটকে ভেঙে ফেলার শক্তি এখন অবধি সরকার গড়ে তুলতে পারেনি। মধ্যস্বত্বভোগকারীদের পেটে লভ্যাংশ ঢুকে পড়ে। চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী। বিশ্বজুড়ে যখন চলছে করোনা ভাইরাসের মতো মরণঘাতী রোগ। রেহাই পাচ্ছে না পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলোও। এক অদৃশ্য শক্তির মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে সবাই। সেই ঢেউয়ের উতরোল বাংলাদেশেও। তখন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সামগ্রীর দাম আকাশ ছুঁয়ে দিল। পরিস্থিতি যখন প্রতিকূলে সেখানেও বসে অর্থলোলুপ মানুষগুলো খাদ্য মজুত করতে শুরু করল। কী ন্যাক্কারজনক অবস্থা। মহামাতমের সময় বাংলাদেশের অর্থলোলুপ মানুষগুলোর জন্য আজ নিম্নআয়ের মানুষদের পেটে খাবার নেই।

বাংলাদেশের বুকে তীব্র এক খাদ্য সংকট অর্থনৈতিক পরাভব ঘটলে। কী হবে জানেন? অনুধাবন করুন। ভবিষ্যতের বাস্তব একটা চিত্র তুলে ধরি। শীতকালে আমরা ব্যাঙ-কে বাইরে দেখতে পাই না। গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে হয়। তাই ব্যাঙ অন্যান্য ঋতুতে নিজের সম্বল পেটের চর্বি জমায়। শীতকালে গর্তে বসে বসে পেটের চর্বি খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে জোগান দেয়। দেশের মানুষ যারা সঞ্চয় হিসেবে অর্থকড়ি জমিয়েছে, তারা মন্দায় ব্যাঙের মতো জমানো চর্বি দিয়ে বেঁচে থাকবে।

গরিবগুর্বা খেটেখাওয়া মানুষদের বলা হয় হ্যান্ড টু মাউথ। তাদের পেটের চামড়া পিঠে ঠেকবে। অথচ যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করে থাকে। উৎপাদনের জন্য তাদের কীটনাশক, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম ঠিক পরিশোধ করতে হয়। তাদের করুণ অবস্থায় সম্মুখীন হতে হয়। বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করে কৃষকদের বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশের পর্যুদস্ত অর্থনীতির চাকা আবার নতুনরূপে প্রাণ পাবে।

হাসনাত মোবারক : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

 
Electronic Paper