ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে

মোহাম্মদ নজাবত আলী
🕐 ১:৩১ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩০, ২০২০

বাংলাদেশের বৈদেশি মুদ্রা অর্জনের যে কয়েকটি খাত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কৃষি ও পোশাক খাত। কৃষি খাতের পরেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত পোশাক শিল্প। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সর্বব্যাপী সংক্রমণের কারণে এক মহাদুর্যোগ শুরু হয়েছে। মানুষের মধ্যে ভয় ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউন চলছে। জল, স্থল, আকাশ পথ বন্ধ রয়েছে। যার কারনে পণ্যসামগ্রী আমদানি রপ্তানিও আপাতত বন্ধ রয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সারা বিশ্ব ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

তাই শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনা ভাইরাসের মারাত্মক বিস্তার রোধে স্ব স্ব দেশ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এ সংক্রামক রোধ করা যাচ্ছে না। ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ^নেতারা এই মুহূর্তে বলতে গেলে ঘরে বসে দেশ চালাচ্ছেন। সভা সমাবেশ সীমিত করেছেন। একই সঙ্গে উদ্বেগের বিষয় হলো, করোনা ভাইরাস শুরুর দিকে আমদানি কমে গেলে যতই দিন যাচ্ছে ততই এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে এবং রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়েছে। যার কারণে দেশের সব অর্থনীতির খাতেই বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।

বিশেষ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির গবেষকদের আশঙ্কা, বৈদেশিক খাত পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সরকারি অর্থায়ন, আমদানি-রপ্তানি, রেমিটেন্সের নেতিবাচক প্রভাব এবং পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মন্দার কবলে পড়বে দেশের অর্থনীতি। এতে মানুষের আয় কমে যাবে, অনেকেই বেকার হতে পারে। সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আদায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বছর শেষে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অতি সম্প্রতি করোনার ক্ষতি নিয়ে মিডিয়া বিফ্রিংয়ে একথা তুলে ধরেন গবেষকরা। করোনা এ নেতিবাচক প্রভাব শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, র্গামেন্টস বা পোশাক শিল্পে এর প্রভব ক্ষতিগ্রস্থ করবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে।

কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। অধিক খাদ্য উৎপাদনের ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসাবে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। এ খাতের উন্নয়ন হলেও এ খাতের সঙ্গে যারা জড়িত সে অবহেলিত কৃষক সমাজের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। তাই কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলে খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে এর সিংহভাগ কৃতিত্ব কৃষক সমাজের। ফলে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির ধরন। কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে। ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ অবস্থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য বিশ্ব ব্যাংকের।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, এ দেশের মানুষ খুবই কষ্ট সহিষ্ণু তারা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। দেশে বিদেশে নানা কাজে নিয়োজিত থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরার ভূমিকায় পালন করছে বিদেশে কর্মরত প্রায় ৮০ লাখ কর্মজীবী নারী-পুরুষ। তাদের প্রেরিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ভারী করছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের কর্মরত শ্রমিকরা তাদের পাঠানো অর্থ এক দিকে তাদের পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত হচ্ছে। কেন না সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে তাদের কর্মপ্রচেষ্টা ও বৈদেশিক অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

শুধু বিদেশি রেমিটেন্সই নয় আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পখাত জাতীয় অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুরু থেকেই বাংলাদেশের পোশাক বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রশংসা অর্জনের পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে এর চাহিদাও বাড়ছে। এই শিল্প প্রায় ১.৫ বিলিয়নের লোকের কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা করেছে। একই সঙ্গে অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা যা আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পোশাক শিল্পের তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানির অর্থ জাতীয় অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্যে অংশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন শ্রমিকের পাঠানো রেমিটেন্সের পর বৈশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক দেশের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কী রূপ অবদান রাখছে। এককথায় বলতে গেলে বাংলাদেশে রেমিটেন্সের পর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প।

কিন্তু সর্বনাশা করোনার প্রভাবে আমাদের কৃষি, পোশাক শিল্পসহ নানা খাতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। তবে বিশ্বের প্রায় দেশে বিস্তার ঘটা করোনা ভাইরাসের প্রভাব কতটা ভয়াবহ বা কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা জানার জন্য এখনো তা সম্ভব নয়। কেননা প্রতিদিনই পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। চীন ভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনলেও বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে তা দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে করোনা। ইতালি, স্পেন, আমেরিকায় যেভাবে প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে তাতে মনে হয় এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসা সময়সাপেক্ষ। করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক ওষুধ বা টিকা এখনও আবিষ্কৃত না হওয়াই গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্যঝুঁকি যে কতটা ভয়াবহ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একসময় এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসবে। সঙ্গত কারণে বিশ্ব অর্থনীতিসহ বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

এ ভাইরাসে গোটা পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যাবে তার চেয়ে বেশি মানুষের জীবন হবে বিপন্ন। নিঃস্ব হয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধে নেমে পড়বে অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে গ্রামে অতি দারিদ্র, ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ছিন্ন মানুষরা চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়বে। অতি সম্প্রতি ঢাকার রূপনগর বস্তিতে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো ইতোমধ্যে চরম বিপাকে পড়েছে। আর্থিক দৈন্য দেখা দিয়েছে। জানা যায়, তারা খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছে। না আছে তাদের বাড়িঘর, না আছে থাকার জায়গা। খোলা আকাশের নিচে কোনোমতে তারা বেঁচে আছে। সরকারের সাহায্য সহযোগিতাও পর্যাপ্ত নয়। এসব ছিন্নমূল মানুষের চোখে শুধু বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। তাদের কোনো আয় রোজগার নেই। পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য একদিনের খাবার দু’তিন দিনে পরিবার পরিজন নিয়ে খাচ্ছে। এ চরম দুর্যোগের সময় এসব অতি দরিদ্র মানুষের পাশে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা মানবিক দায়িত্ব বলে মনে করি।

তবে আশার কথা, করোনার প্রভাব দেশের খাদ্যাভাব তৈরি করবে না। বিগত ২০০৮ সালে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে বিশ্বময় মন্দা দেখা দিয়েছিল। চরম সংকটে পড়েছিল সারা বিশ্ব। ইউরোপ, আমেরিকার মতো কিছু উন্নত দেশগুলোতে চরমভাবে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়ে বিশ্ব। কিন্তু বিশ্ব মন্দ পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে তা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এর মূল কারণ ছিল, সে সময় আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ ছিল। রোদে পোড়া কৃষকরা যথেষ্ট কৃষিপণ্য উৎপাদন করে যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে কৃষিপণ্যের যথেষ্ট উৎপাদন ও মজুদ রয়েছে। এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দেশে এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ টন খাদ্য মজুদ আছে যা গত বছরের চেয়ে দেড় লাখ টন বেশি। তবে খাদ্যশস্য যতই মজুদ থাক না কেন, কোনো অসাধু ব্যবসায়ী যেন পণ্যের দাম বাড়াতে না পাড়ে সে দিকে অবশ্যই সরকারের নজরদারি বাড়ানো জরুরি। এ লক্ষ্যে অবশ্য সশস্ত্র বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি দুর্নীতি, অর্থপাচার, রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে সরকারকে এ মুহূর্তে কঠোর পদক্ষেপ করতে হবে। একই সঙ্গে করোনার প্রভাব ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক হওয়া দরাকার।

করোনায় কী পরিমাণ ক্ষতি হবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির তা এখন বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে তার ইঙ্গিত দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ১ শতাংশের সমান। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক ইউরোপের বাজার বন্ধ থাকাই বিক্রি একেবারেই কমেছে। দেশের আধিকাংশ গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ রয়েছে। এমনকি ক্রয়াদেশ দেওয়া বেশকিছু চালান আপাতত স্থগিত রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ৮০ শতাংশই যায় ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে। তাই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের পোশাকখাত এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তাই এ অবস্থায় যে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এই ভয়াবহ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের ধারণা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধরনের তারল্য সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে রাজস্ব আয়ে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা কাটিয়ে উঠতে এখনই সরকারকে সঠিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

বাংলাদেশের মানুষ ভয়কে জয় করেছে এমন নজির রয়েছে অতীতে। বায়ান্ন থেকে একাত্তরÑ এ দীর্ঘ সময় এ দেশের মানুষ প্রতিবাদ প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বর্তমান করোনায় যে, ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়েছে এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা ও কিছু প্রতিষ্ঠান আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তা সরকার ও জনগনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে তা অনেকটা কাটিয়ে উঠবে। তবে সাময়িকভাবে আমাদের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় পড়লেও সময়ের ব্যবধানে তা থেকে উত্তরণ ঘটবে এমনটি আশা করা যায়।

মোহাম্মদ নজাবত আলী : সহকারী শিক্ষক, চামরুল উচ্চ বিদ্যালয় দুপচাঁচিয়া, বগুড়া

 
Electronic Paper