এ অন্ধকার কাটবেই
রনি রেজা
🕐 ১:২৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩০, ২০২০
থমকে গেছে পৃথিবী, থমকে গেছে সময়। দুরন্ত ছুটে চলা বিশ্বকে অসাঢ় করে দিয়েছে করোনা নামে একটি আনকোরা ভাইরাস। একের পর এক লকডাউন হচ্ছে দেশগুলো। বন্ধ হচ্ছে কল-কারখানা। বিভিন্ন দেশের মধ্যকার আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধের পথে, বলা যায় জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী ছাড়া অন্য সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের দেশগুলো ‘একা’ হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও ক্রমে বন্ধ হচ্ছে। এতে শহর থেকে শহর বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, জার্মানির মতো দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে এই অচেনা শত্রুকে দমাতে। মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী এই প্রাণঘাতী রোগে মারা গেছেন ৩০ হাজার ৮৮৮ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লাখ ৬৪ হাজার ২২১ জন এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এক লাখ ৪২ হাজার ৩৬৩ জন। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মহামারি আকারে করোনা ছড়ায়নি। তবে প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশে। মৃত্যুও হচ্ছে। শঙ্কার খবর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। লেখাটি তৈরির সময়কার হিসাব অনুযায়ী আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশে করোনায় মৃতের হার ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত দুই দিনে রোগীর সংখ্যা বাড়েনি। এটা স্বস্তিদায়ক। আমরা চাই না বাড়–ক। এজন্য জরুরি সাবধানে থাকা।
যতটা সম্ভব বাইরে বের না হওয়া। সরকার ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠাগুলো বাদে সরকারি-বেরসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঘরে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। সরকারের এমন উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধু সরকার উদ্যোগী হলে চলবে না। প্রয়োজন ব্যক্তিসচেতনতা।
প্রতিটি মানুষ সচেতন হলে এই অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবেলা করতে সহজ হবে। এজন্য প্রথম কথা হচ্ছেÑ ঘরে থাকতে হবে। অনেকে থাকছেনও। আবার ঘরে বসে থাকতে থাকতে বিষণœতা, উদ্বেগ, অস্থিরতা কাজ করছে মানুষের মাঝে। ছটফট করতে করতে আবার রাস্তায় বেরিয়ে আসছে মানুষ। কেউ বুকভরে দম নিতে। কেউ ক্ষুধার তাড়নায়। তাদের রুখতে নিয়োজিত আছে প্রশাসন। সব মিলিয়ে একটি অস্থির সময় যাচ্ছে; সন্দেহ নেই। এতে বেদনা আছে। দম বন্ধ করা অস্বস্তি আছে। আছে কিছু নিয়মের বদ্ধতা। প্রকৃতি তার প্রয়োজনেই নিয়মে ফেরায়। ফিরতে বাধ্য করে। এ যেন সেই সময় চলছে। ভালো থাকতে হলে একা থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রিয়জনকে আলিঙ্গনে জড়াতে পারব না। চুমু খেতে পারবো না প্রিয় সন্তানকে। অফিস থেকে ফিরেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া সন্তানের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে ঢুকছি ওয়াশরুমে। আবেগ মিশিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে পারব না। সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আগন্তুককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে হ্যান্ডশেক না করেই।
প্রিয়জন মারা যাচ্ছে; লাশ বুকে জড়িয়ে আহাজারি করতে পারছে না স্বজনরা। জানাজা সৎকারেও নেই খুব উপস্থিতি। বাঙালি সত্তা এ কিছুতেই মানতে চাইছে না। আবার নিজেকে বোঝাচ্ছিÑ এ নিয়মগুলো ভালো রাখবে আমাদের। করোনা একদিন চলে যাবে। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। সুন্দর নিয়মগুলো থেকে যাবে আমাদের মঙ্গলে। সেই মঙ্গলময় আগামীর জন্য ভালো থাকতে হবে আমাদের। রুখতে হবে করোনা নামধারী এই বিশ^শত্রুকে। রুখতে হলে প্রয়োজন সামাজিক ঐক্য। একত্রিত হতে হবে পুরো বিশ^কে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি ভেদ ভুলে এক হতে হবে এই করোনা রোধে। লকডাউনের এই সময়ে সবচে বিপদে নিম্নআয়ের মানুষ। যারা একদিন কাজ না করলে চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
এরই মধ্যে এমন খবর পাচ্ছি। অনেক প্রতিষ্ঠান নিম্নআয়ের মানুষের এক সপ্তাহ বা এক মাসের খাবারের দায়িত্ব নিচ্ছে। অনেকে নিচ্ছেন ব্যক্তি উদ্যোগে। সরকারি তহবিল থেকেও অনেক জেলা/ উপজেলা প্রশাসন এই মহতী উদ্যোগ নিচ্ছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে। দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্তের দিকে অগ্রসর হওয়া দেশটিতে নিম্নআয়ের মানুষই যে বেশি! তাই তো হাতে গোনা উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান সহজ নয়। এগিয়ে আসতে হবে বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে। এগিয়ে আসতে হবে শীর্ষ তালিকায় থাকা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের। সচেতনতামূলক বাক্যে বলা সামাজিক দূরত্ব যেন হৃদ্যতা কমিয়ে না দেয়; সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখেই পাশে থাকতে হবে অসহায় মানুষগুলোর। পাশে থাকতে হবে আপনজনেরও। কয়েকদিন আগে কবি ও গবেষক রঞ্জনা বিশ^াসের একটি পোস্ট চোখে পড়ল। তিনি লিখেছেনÑ ‘মরণে আমার ভয় নাই কিন্তু মরিবার আগে দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু দেখিয়া মরিতে চাই।’ সঙ্কটকালে মানুষ সবচেয়ে বেশি থাকে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে। কেউ একটু খোঁজ নিলে, সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেই যেন গলে যায় মন। ভরসা পায়। ভাইরাস এসেছে, চলেও যাবে। হয়ত কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু এই সঙ্কটময় মুহূর্তের শিক্ষা আমাদের যেন সজীব করে, সতেজ করে। এই একলা চলো নীতি যেন কোনো সম্পর্কে ফাটল না ধরাতে পারে।
এই অচেনা ভাইরাসের ভয় যেন আপনজনের হৃদয় থেকে দূরে না সরিয়ে দেয়। নিরাপদে থাকতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পাশে থাকতে হবে সাধ্যমতো। হতে হবে আরো ঐক্যবদ্ধ। আমরা বিশ^াস করতে চাইÑ প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এই বিধ্বংসী ভাইরাসও আমাদের ইতিবাচক কিছু দিয়ে যাবে। সেগুলো আমাদের আগামী দিন আরো ভালো করবে। আলো ছড়াবে। আমরা জড়ো হবো শাহবাগের আড্ডায়। হেসে গড়াগড়ি খাব। বন্ধুকে দেখামাত্র টেনে নেব বুকে। করমর্দনে অভিবাদন জানাব আগন্তুককে। আন্তরিকতায় মুগ্ধ করব বিদেশি বন্ধুকে। এগুলোই তো আমাদের সম্পদ। এগুলোই আমাদের অহংকার। এগুলোই আমাদের পরিচয়।
রনি রেজা : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক
[email protected]