সচেতন না হলে সামনে বিপদ
অয়েজুল হক
🕐 ১:২১ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০২০
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহান শহরে সামুদ্রিক মাছ ও বন্যপ্রাণী বিক্রি হয় এমন একটি বাজার থেকে প্রথম নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস মানুষের ভেতর সংক্রমণ ঘটায় বলে জানা যায়। প্রায় সারা দুনিয়ায় করোনা ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছে। এর পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে কোভিড-১৯। এটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি বা নভেল করোনা ভাইরাস। চীনে তা-ব চালানো এ ভাইরাসে বর্তমানে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। চীনকে ছাপিয়ে ইতালি এখন মৃত্যুপুরী।
স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার অবস্থাও ভয়াবহ। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, এমন প্রতিটি দেশই নাস্তানাবুদ হচ্ছে। বিজ্ঞান, মানুষ, মানবতা সব যেন অসহায়। মৃত্যুর দিক দিয়ে ইতালি এখন পর্যন্ত শীর্ষে। তবে খুব কাছাকাছি অবস্থান স্পেনের। প্রতিদিন হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা যাচ্ছে। ভারী হচ্ছে মৃত্যু মিছিল।
ইতালি প্রথম দিকে এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকে বলেছিলেন, জ্বর বা জ্বরের মতো কিছু। যখন বোধোদয় হয়েছে; হয়ত সামান্য একটু দেরি হয়ে গেছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ইতালির সরকার কর্তৃক কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরবর্তীকালে সারা দেশ লকডাউন করেও করোনার বিস্তার রোখা যায়নি। জাঁকজমক শহরগুলো এখন ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। স্পেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন একই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। অলরেডি চলেও গেছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় নেতা কেউ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। ভাইরাসে রাজনৈতিক নেতাদের ঝুঁকি একটু বেশিই। কারণ ইচ্ছা করলেই তারা জনবিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। ঝুঁকি রয়েছে চিকিৎসকদের। সম্পূর্ণ নতুন এ ভাইরাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো আবার ‘যদি, হয়ত’ শব্দের ভেতর আটকা।
আপাতদৃষ্টিতে বেশ কিছু দেশ পরিত্রাণ লাভ করেছে। যতটুকু জানা গেছে, ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে দেশগুলো কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করে প্রাদুর্ভাব থেকে নিজেদের মোটামুটি রক্ষা করেছে। এক্ষেত্রে হংকং, সিঙ্গাপুর দৃষ্টান্ত হতে পারে। চীনের একেবারে নিকটস্থ দেশ সিঙ্গাপুর। কাছাকাছি সময়ে আক্রান্ত হওয়া দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৩৪৫ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছে ১২৪ জন মারা গেছে মাত্র ২ জন। চিকিৎসাধীন আছে ২১৯ জন। হংকংও দারুণ সফলতা দেখিয়েছে। সফলতার কাহিনী একই, সংক্রমণের শুরুতেই তারা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। একটুও দেরি করেনি।
আমরা কিন্তু যথেষ্ট সময় পেয়েছি। দুই মাস তো বটেই। বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চে। একজন প্রবাসী ছিলেন ভাইরাসের বাহক। ইতালি, ইউরোপজুড়ে যখন মহামারি চলছে সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এল। আসতেই পারে। তবে যারা এসেছেন তাদের কঠিনভাবে মনিটরিং করা দরকার ছিল। দেশে এসে তাদের মহানন্দে ঘুরে বেড়ানো কিছু দিনের জন্য কঠোরভাবে আটকানো যেত। সেটা কিছুটা হয়েছে, সবটা নিশ্চয়ই হয়নি। প্রস্তুতি নেওয়ার সম্ভাব্য সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই প্রস্তুতি নিতে হয়।
বিভিন্ন পত্রিকার তথ্যে, বিরাট সংখ্যক বিদেশফেরত মানুষ হিসাবের বাইরে। তাদের খোঁজা হচ্ছে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তারাও নজরদারির ফাঁকে নিয়ম ভেঙে সামাজিকভাবে মেলামেশায় লিপ্ত। ফলাফল প্রবাসী থেকে দেশের মানুষ। এখন সেটা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে স্থানীয় সংক্রমণের দিকে যাকে ভিন্নভাবে বললে বলা যায়Ñ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। আগামী দু-তিন সপ্তাহ হতে পারে করোনা ভাইরাসের পিক টাইম। ভাইরোলজি (জীবাণু) বিশেষজ্ঞদের মতে, পিক টাইমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাইরাসটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা আগেই জেনেছি, প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। কমিটি ছিল। দুর্যোগকালীন কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার জন্য অনেক কমিটির কথাও বলা হয়েছে। আমরা কী করব? স্কুল বন্ধ হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। ফার্মেসি, কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান ছাড়া সব বন্ধ। যানবাহন বন্ধ। উদ্দেশ্য একটাই মানুষ যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
ছুটির দিনেই দেখা গেল আতঙ্ক নিয়ে মানুষ গ্রামে যাওয়ার জন্য অতি ব্যস্ত। তারা ভিড় জমালেন। হুড়োহুড়ি হল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখন গ্রামে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, সামাজিক দূরত্ব না মেনে গাদাগাদি করে বিভিন্ন পরিবহনে মানুষ গ্রামে ফিরেছেন সেটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ কেউ বলছেন আগে যাতায়াতের সব ব্যবস্থা বন্ধ করে ছুটি ঘোষণা করা হলে মানুষ তার স্ব স্ব স্থানে থাকতে বাধ্য হত। এতে সারা দেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠত না। অবশ্য যানবাহন বন্ধের পরও বিকল্প পথে গ্রামে ফিরেছে হাজারো মানুষ।
বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে যাওয়ায় ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ছুটি পেয়ে গ্রামে ফেরা মানুষগুলো কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করেছেÑ এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, সবাই যেন বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত পুরোপুরি মেনে চলেন। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে পৃথকভাবে অবস্থান করতে হবে। অন্যথায় রোগটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মানবে! সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে যাদের ছুটি দেওয়া হল প্রথম দিনেই তারা দেখিয়ে দিল সামাজিক দূরত্ব কাকে বলে। মাঝে-মাঝে খুব অবাক হই। পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী শহরের প্রধান সড়কগুলোতে, বিভিন্ন স্পটে মানুষের সমাগম, মেলামেশা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনলেও গ্রামের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। অথচ গ্রামগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ছেলেমেয়েরা ইচ্ছামতো ঘুরছে। আড্ডা দিচ্ছে। বিভাগীয় শহরের মানুষগুলোও যে সেটাও মনে হচ্ছে না। আমার সামনেই একজন বললো, সন্ধ্যা ছয়টার পর সব আড্ডা বন্ধ।
আমি খুব অবাক হয়ে শুধু ভেবেছি, করোনা ভাইরাস কি সন্ধ্যার পরে রোগের বিস্তার ঘটায়? গোপনে গোপনে বাসা বাড়িতে চলছে কোচিং বাণিজ্য। অসংখ্য জায়গায় মানুষ একেবারেই খোশমেজাজে আড্ডাবাজি, খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট কথাÑ যেন ছুটির আনন্দ, আহা কী মজা...। এরা যে ঘটনা জানে না বা বোঝে না এমন নয়। অনেকে আবার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে। কিন্তু এ রোগ শুধু নিজে সচেতন থাকলেই যথেষ্ট নয়। পাশের লোক হতে পারে আপনার বিপদের কারণ। স্কুল বন্ধ করা হয়েছে কিন্তু ছাত্র যদি দিনভর রাস্তা দিয়ে টো টো করে বেড়ায় লাভ কী হল? এক্ষেত্রে অভিভাবকরা কতটুকু দায়িত্বশীল? শিক্ষক যখন চায়ের স্টলে বসে আড্ডা দেয় আর বিড়ি ফোঁকে তখন বুকটা গর্বে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। অবাক হই, সেই লোকটাই যখন ভয়ানক ঘটনাগুলো বলে চলেনÑ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, আমেরিকা... ইস কী একটা অবস্থা!
ব্যাংক চলছে দু’ঘণ্টা। কিছু ব্যাংকে এখনো পিতলের টোকেন সিস্টেম। প্রচুর মানুষ আছে। ভিড় করে টোকেন নিচ্ছে। টোকেনগুলো ঘুরে ঘুরে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হাতে যাচ্ছে। অল্প জায়গায় অনেক মানুষ। একজনের ঘাড়ের ওপর দিয়ে লাফ মেরে আরেকজন টাকা নিয়ে যেতে পারলে যেন বেঁচে যান। কেউ থুথু লাগিয়ে টাকা গুনছেন। দড়িতে বাধা একটা কলম নিয়ে চেকের পাতায় সই করছেন অনেকে। এগুলো বিশৃঙ্খল গণজমায়েত।
ডায়মন্ড প্রিন্সেস নামক জাহাজের কথা আমরা জানি। সেখানে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। এই জাহাজ নিয়ে গবেষণা করে গবেষকরা বলেছেন, ধাতবে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকে করোনা ভাইরাস। পরীক্ষার জন্য একটি কেবিন জীবাণুনাশক না করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। ১৭ দিন পরেও সেখানে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি মেলে। মার্কিন গবেষক এবং সেন্টার ফর ডিজিস অ্যান্ড কন্ট্রোল প্রিভেনশনের প্রধান ডা. টম প্রিডেন বলেন, মশা যেমন ম্যালেরিয়া ছড়ায়, এঁটেল পোকা রোগ ছড়ায়, তেমনি জাহাজে এটি ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে এটি ছড়াল, তা এখনো জানা যায়নি। গবেষকদের মতে মোবাইলে নয় দিন, কাপড়ে একদিন থেকে দুইদিন, প্লাস্টিকে চারদিন, বাতাসে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত করোনা ভাইরাস থাকতে পারে।
আমাদের দেশে যেহেতু আক্রান্ত রোগী আছে সেহেতু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া লিফট, দরজার হাতল, এটিএম মেশিন ঘরের নানান আসবাবপত্র, বাজার থেকে কেনা যে কোনো কিছু, বাইরে বেরিয়ে পরা জামাকাপড়, মোবাইল ফোন, স্যান্ডেল, টাকাপয়সা সর্বোপরি বাইরের যে কোনো কিছু সংক্রমণের কারণ হতে পারে। বাইরে খাওয়া পরিহার করা দরকার। বারবার হাত পরিষ্কার করুন। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের জন্য উতলা হওয়ার দরকার নেই। যে কোনো সাবান দিয়ে হাত ধোবেন। ওজু করুন, নিয়মিত নামাজ পড়ুন। আত্মার প্রশান্তির জন্য ধর্ম পালনের বিকল্প কিছু নেই। এতে আতঙ্ক দূর হবে।
বাস্তবতা মেনে নিয়ে বলতেই হবে, ইতালি, স্পেনসহ গোটা ইউরোপ ও আমেরিকার যে অবস্থা (এমনটা যেন না হয়) তা সামাল দেওয়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নিজের জন্য, দেশের জন্য, মানুষ ও মানবতার জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। যদি তা না হই, সামনে বড় বিপদ আসতে পারে।
অয়েজুল হক : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]