এ যুদ্ধেও জিততে হবে
সাহাদাৎ রানা
🕐 ৭:১৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৮, ২০২০
সারা বিশ্ব এখন করোনা নামক একটি ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছে। যে লড়াইয়ে বিশ্বের অনেক মানুষ পরাজিত হয়ে বরণ করছে মৃত্যুকে। সেই পরাজিত হয়ে মৃত্যুর মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। বিশেষ করে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেনের মতো উন্নত রাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মহামারি আকারে করোনা ছড়ায়নি। তবে প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন করোনা ভাইরাসের কারণে। এটাই আপাতত সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
স্কুল কলেজ বন্ধ করা হয়েছে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সারা দেশে সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছে। এরপর থেকে মানুষের মনে কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। সবাই যার যার বাসায় অবস্থান করছে। এখন এই আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে সবাইকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করতে হবে। আর বাঙালি এই আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস। কেননা, বাঙালি আত্মবিশ্বাসী জাতি। যার প্রমাণ সব সময় দিয়ে যাচ্ছে। এর আগে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের তাজা রক্ত নিয়ে দেশ স্বাধীন করে বিশ্বের বুকে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ করেছে। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বের বুকে।
এবারও বাঙালির সামনে নতুন এক যুদ্ধ। যে যুদ্ধে বাঙালি শক্রর নাম করোনা নামক ভাইরাস। যে ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। এবার সেই যুদ্ধে সামিল হয়েছে বাংলাদেশও। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ এ যুদ্ধে জিততে কতটা প্রস্তুত। এখানে সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ এখন পর্যন্ত এই রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে বাস্তবতা হলো ওষুধ আবিষ্কার না হলেও এখন এ রোগ প্রতিরোধে সবেচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। কিন্তু আমাদের ভয়ের পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। প্রধান কারণ হলো আমরা নাগরিকরা সেভাবে সচেতন নই। এছাড়া আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি রয়েছে। প্রথমত আমরা নিজেদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সব সময়ই কিছুটা উদাসীন। কিন্তু এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচতেনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
কেননা, এখানে আপাতত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। সবাইকে হতে হবে সচেতন। আমাদের জন্য আশার খবর হল সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু এবং মাথাপিছু আয়ও। প্রতিবছর বাড়ছে বাজেটের আকারও। এত কিছু বাড়ার পরও কিছুটা শঙ্কা রয়েছে সবার মনে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে। কেননা, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি ব্যয় তেমন বাড়েনি। পাশাপাশি বাস্তবতা হলো আমরা এখনও নানা কারণে স্বাস্থ্য সেবায় আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তবে এটাও সত্য যে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। বিশেষ করে সংক্রামক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সফলতা প্রভূত। এমন একটা সময় ছিল যখন হাম, বসন্ত, কলেরা, প্লেগে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে। সেই কঠিন সময় আমরা অনেক আগেই পার করে এসেছি। হাম, বসন্ত, কলেরা ও প্লেগ এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।
এমনকি পোলিও নির্মূল হয়েছে অনেক আগেই। ডায়রিয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওরস্যালাইন এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন; আর এর কৃতিত্ব বাংলাদেশের। উন্নত কোনো দেশে হলে নিশ্চিত নোবেল মিলত। অথচ আমরা ভেবেও দেখি না, অত্যন্ত সরল এক সমাধান সারা বিশ্বের প্রতিনিয়ত অযুত-নিযুত মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। এ যেন এক জাদুকরী নিদান। এছাড়া সফলতা এসেছে মা ও শিশুর মৃত্যুর ক্ষেত্রেও। আগের তুলনায় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে এসেছে। আবার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। বতর্মান সময়ে আমাদের দেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে; যা রীতিমতো আশঙ্কার, আতঙ্কের। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, পক্ষঘাতগ্রস্ততা, কিডনী রোগ, অটিজম ও মানসিক রোগীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত।
এখন সবার জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে এসেছে করোনা। তাই প্রশ্ন উঠেছে আমাদের সক্ষমতা নিয়ে। তবে আশার খবর হলো করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ইতিমধ্যে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সকল হাসপাতালে গাউন, মাস্ক ও গ্লাভস যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে উদ্যোগ নিলে হবে না। সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে সবাইকে। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, এসপি, ইউএনও, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। যদি কেউ এক্ষেত্রে আইন না মানে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। করোনা ভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে সরকার ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই হবে না। পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা যেন বাইরে ঘুরে না বেড়ায় সেই দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে অভিভাবকদের। তবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। কেউ যেন এলাকার গলিতে ঘোরাঘুরি না করে সেই দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
তবে আমাদের করোনার বিপক্ষে যুদ্ধজয়ে কিছু বাধা রয়েছে। ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ অহেতুক গুজব সৃষ্টি করছে। আর সেই গুজবে কান দিয়ে কিছু মানুষ অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য কিনছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রয়েছে। এক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছু মানুষ তা মানছেন না। তাই এ বিষয়ে সরকারের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন করোনা ভাইরাসের বিষয়ে সবচেয়ে আশার খবর হলো, করোনা একটি ছোঁয়াচে রোগ হলেও অধিকাংশ মানুষ এ রোগে সুস্থ হয়ে যান।
এক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। সতর্ক ও সচেতনতার মধ্যদিয়ে মূলত করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। এখন সবাইকে মনে রাখতে হবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যকেও সচেতন হতে পরামর্শ দিতে হবে। তবেই করোনার বিরুদ্ধে আমরা এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারব।
সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]