বর্মহীন সৈনিকের যুদ্ধ!
আহমেদ শরীফ শুভ
🕐 ৭:০৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৮, ২০২০
অস্ট্রেলিয়ার একটি সুপার মার্কেট চেইন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য জরুরি কাজে নিয়োজিতদের জন্য সপ্তাহে দুই দিন ১ ঘণ্টা করে এক্সক্লুসিভ শপিং আওয়ার ঘোষণা করেছে। এই সময়ে তারা ছাড়া অন্য কেউ ঐ চেইন সুপার মার্কেটে ঢুকতে পারবেন না। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পরপরই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্যানিক বায়িং শুরু হয়েছে। ভোর বেলায় সূর্য ওঠার আগেই এসব সুপার মার্কেটের সামনে লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। যেহেতু স্বাস্থ্যকর্মী ও জরুরি কাজে নিয়োজিতরা করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম কাতারে আছেন তাই তাদের সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তারা যখন নিজেদের কাজের শিফট শেষ করে সুপার মার্কেটে যান, তখন অনেক জিনিসই শেষ হয়ে যায়। তাদের ভোগ্যপণ্যের প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় সুপার মার্কেটের এই সিদ্ধান্তটি সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু কফি শপ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিনামূল্যে কফি খাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। বিষয়টি এমন নয় যে স্বাস্থ্যকর্মীদের কফি খাওয়ার পয়সা নেই। বরং তা হচ্ছে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিরলস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের প্রতি কমিউনিটির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি প্রচেষ্টা। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনের প্রতি এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার এই যে প্রচেষ্টা তার জন্য কিন্তু মিলিয়ন ডলারের বাজেটের প্রয়োজন হয়নি। প্রয়োজন হয়েছে সংবেদনশীল চিন্তার এবং কৃতজ্ঞ মনোভাবের।
অথচ, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে চিত্রটি একেবারেই অন্যরকম। দেশে একজন জুনিয়র ডাক্তার তার ডিউটি থেকে ফেরার পথে বিনা কারণে পুলিশের হাতে প্রহৃত হচ্ছেন। শুধু বিনা কারণটিই বিষয় নয়। কোনো কারণ থাকলেও কি একজন ডাক্তারকে কোনো পুলিশ প্রকাশ্য রাজপথে প্রহার করার এখতিয়ার রাখে? এই নিয়ে কোন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও শোনা যায়নি। শুধু তাই নয়, ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার বিএমএ এটা নিয়ে প্রশাসনের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেছে বলেও দৃশ্যমান নয়।
স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন রক্ষাকারী বর্ম পিপিই (পারসোনার প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট)’র ব্যাপারেও একশ্রেণির প্রশাসনিক কর্মকর্তা যে বালখিল্যতা দেখাচ্ছেন তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। সারা পৃথিবীতেই পিপিই’র সংকট চলছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ায়ও সরকার হিমশিম খাচ্ছে পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করতে। তাই বলে পৃথিবীর কোথাও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয় এমন কেউই পিপিই পড়ে অফিস করছেন না বা ঘোরাফেরা করছেন না।
যারা কোভিড-১৯ এর চিহ্নিত কিংবা সন্দেহভাজন রোগী দেখবেন তাদের জন্যই পিপিই নির্ধারিত। যেহেতু এখন অপ্রকাশ্যে হলেও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গেছে এবং যেহেতু কোভিড-১৯ এর অনেক রোগীরই প্রথম দিকে কোনো উপসর্গ থাকে না তাই সব স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যই এখন পিপিই’র ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অথচ, বাংলাদেশে একদিকে জনৈক মন্ত্রী বলছেন ‘এখনো পিপিইর তেমন দরকার নেই’ অন্যদিকে একদল সরকারি কর্মকর্তা অফিস করছেন পিপিই পরে। সেই সঙ্গে নিজেদের গ্রুপ ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আপলোড করছেন। শুধু তাই নয় কাউকে পিপিই পরে তাস খেলতেও দেখা গেছে। সে সব ছবিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসেছে। এই বাংলাদেশেই স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
কিন্তু উপজেলার সরকারি অফিসগুলোতে, ব্যাংকে এখানে সেখানে পিপিই বিতরণ করা হচ্ছে। পিপিই’র এই অবিবেচিত সরবরাহের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে। কোভিড-১৯ যদি মানবতার বিপর্যয় বলে গণ্য হয় তাহলে এ সব অবিবেচক কার্যক্রম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলেই গণ্য হওয়া প্রয়োজন। কারণ, অপ্রয়োজনীয় পিপিই ব্যবহারের ফলে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পিপিই’র অভাবে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যুও হতে পারে। একজন স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব কারণ হতে পারে আরো অনেকগুলো মৃত্যুর। এই দায়ভার কে নেবে? ফেসবুকে ‘উস্কানিমূলক’ পোস্টের জন্য দুজন কলেজ শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সম্প্রতি সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের সুবাদে পোস্ট দু’টি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। পোস্টগুলোতে মূলত ডাক্তারদের অসহায়ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। তাতে হয়ত কিছু বিদ্রƒপের সুর ছিল, কিন্তু উস্কানি ছিল না কোনো। সরকারবিরোধী কোনো প্রচারণা তো নয়ই। যদি সরকারবিরোধী বক্তব্য হতও একটি গণতান্ত্রিক দেশে তো সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলা চাকরিতে বরখাস্ত হওয়ার মত অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে না।
এটা স্পষ্ট যে এক শ্রেণির আমলা অতি উৎসাহী হয়ে এই বরখাস্তের কাজটি করেছেন। তাদের আসল অপরাধ স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অসহায়ত্ব তুলে ধরা।
এই বরখাস্তের সিদ্ধান্তের কারণে আর কেউ কি এই দুর্যোগে ডাক্তারদের পাশে দাঁড়াবেন? তাতে কি তাদের মনোবলে কিছুটা হলেও চিড় ধরবে না? বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র আমরা একটি অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আছি। স্বাস্থ্যকর্মীরা হচ্ছে সেই যুদ্ধের প্রথম কাতারের সৈনিক। তাদের আত্মরক্ষার বর্ম হচ্ছে পিপিই। সৈনিকদের আত্মরক্ষার বর্ম বঞ্চিত করে এবং যেখানে সেখানে হেনস্তা করে কেউ কখনো যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। যুদ্ধজয়ের জন্য আক্রমণের আগে আত্মরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়, সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে হয়। হেনস্তা করে, অপমান করে মনোবল চাঙ্গা রাখা যায় না।
আহমেদ শরীফ শুভ : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী
[email protected]