ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রত্যাশা নতুন সকালের

অমিত গোস্বামী
🕐 ৮:২০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৬, ২০২০

তালাবন্দি কলকাতা থেকে বলছি। এ কলকাতার চিত্র আপনারা কখনো দেখেননি। আমরাও দেখিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু কলকাতা নয়, সারা দেশ লকডাঊনের কবলে। এই টোটাল লক ডাউনের কারণ এই যে, দিন যত এগোচ্ছে নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভারতে। গত মঙ্গলবারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৫১৯। নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮। মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫৪৮টি জেলায় লকডাউন চালু করা হয়েছিল। এবারে করা হল সারাদেশে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার ১৫০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই লকডাউনের সিদ্ধান্তকে বিনা প্রশ্নে সমর্থন করেছে সব কটি রাজনৈতিক দল। অবশ্য উপায়ও ছিল না কারণ আমজনতা এই সিদ্ধান্তই চাইছিল। কী খাব সে কথা পরে ভাবা যাবে, আগে প্রাণে তো বাঁচি। কতিপয় নিতান্ত অকালপক্ব মানুষ ব্যতীত কেউই এই জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞাকে ভঙ্গ করার প্রয়াস গ্রহণ করেনি। কিন্তু কতিপয় পক্ব পাবলিককে লাঠ্যৌষধি ও গ্রেফতারির মাধ্যমে আইনরক্ষকরা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কোনো বেয়াদবি বরদাস্ত করবে না। এই সাফল্যের সরণিতেই প্রধানমন্ত্রী পথ চলতে আদেশ দিলেন সাধারণ মানুষকে। টোটাল লকডাউন।

মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এই লকডাউন জারি থাকবে। ওই সময়ে দেশের কোনও নাগরিকের বাড়ির বাইরে পা রাখা কার্ফুভঙ্গের সমান অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই টাকায় আইসোলেশন ওয়ার্ড, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি। এ কথা প্রত্যেকেই বুঝেছেন, এ এক অসম লড়াই। যে শত্রুকে চোখে দেখা যায় না, বোঝা যায় না কখন কোথা থেকে কীভাবে আক্রমণ করতে পারে, শুধু জানা গেছে সংস্পর্শ এড়িয়ে যেতে পারলে আক্রমণ এড়ানো যেতে পারে, তাকে আর কীভাবে মোকাবেলা করা যেতে পারে লকডাউন ছাড়া?

তবে লকডাউন মানে কী? লকডাউন মানেই কিন্তু সব বন্ধ নয়। বাকি সমস্ত কিছু বন্ধ থাকলেও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য অর্থাৎ পানীয় জল, ব্যাংক, এটিএম, টেলিফোন, ইন্টারনেট, খাদ্য, সবজি, মুদিখানা পণ্য, মাছ-মাংসের দোকান, হাসপাতাল, মেডিক্যাল সেন্টার, ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা, ওষুধের দোকান ও বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু থাকবে। খোলা থাকবে রেশন দোকানও। সেই সঙ্গে কাজ চলবে প্রতিরক্ষা, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেন্টার, পুলিশ, হোম গার্ড, সিভিল ডিফেন্স, দমকল, বিপর্যয় মোকাবেলা দফতর, জেলা প্রশাসন, পুর এলাকার সাফাই, জল সরবরাহের মতো দফতর, সংবাদমাধ্যমে। এছাড়াও টেলিকমিউনিকেশন ইন্টারনেট, ব্রডকাস্টিং, কেবল সার্ভিসের কাজও চালু থাকবে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জন্য আইটি সংযোগের কাজও চালানো যাবে বলে জানানো হয়েছে কেন্দ্রের নির্দেশিকায়। খোলা থাকবে পেট্রোল পাম্পও। তবে, ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যবহৃত হোটেল, লজ বাদে বাকি অন্য কোনও কারণে হোটেল, লজ খোলা যাবে না।

ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশেই এখনও লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। নতুন সংক্রমণ রুখতে লকডাউনের পথে হাঁটছে একের পর এক দেশ। যে হুবেই প্রদেশ থেকেই করোনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, সেখানে বুধবার থেকে উঠে গেল লকডাউন।

কাল থেকেই বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবেন বাসিন্দারা। চালু হচ্ছে যানবাহনও। তবে করোনার আঁতুড়ঘর বলে চিহ্নিত উহান শহরকে এই নির্দেশিকার আওতার বাইরে রাখা হচ্ছে। সেখানে নিয়ন্ত্রণ উঠবে ৮ এপ্রিল থেকে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে এই হুবেই প্রদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সেখান থেকে গোটা হুবেই রাজ্য হয়ে চীনের প্রায় সর্বত্র এবং গোটা বিশ্বের ১৯০টি  জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে উহানসহ হুবেই প্রদেশজুড়ে লকডাউন জারি হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি। কার্যকর একটা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও দরকার আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা। কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউন মহামারি আটকানোর জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু যখন একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে না, মনে করে ওর সমস্যা ওই সামলাক, তখন এই ধরনের শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রের সরকার দোটানায় পড়ে যায়। ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারির সময় আমেরিকা এরকম নেতৃত্বের জায়গায় ছিল।

বর্তমান আমেরিকান প্রশাসন ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাহায্যের পরিমাণ ছেঁটে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমেরিকার বিবেচ্য শুধু নিজস্বার্থ। করোনা সংকট যখন দেখা দিল তখন আমেরিকা বসে সাইডলাইনেÑ সমাধানে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণের কোনো ইচ্ছাই দেখায়নি। কিন্তু তারা লাফালাফি শুরু করল যখন আগুন লাগল তাদের দেশে।

আগেও মহামারিতে কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিমান বা কোনো ক্রুজশিপ ছিল না, তব্ ুব্ল্যাক ডেথ পূর্ব এশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়েছে মোটামুটি এক দশকের মাঝেই। ওতে মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে। ইংল্যান্ডে মারা গিয়েছিল প্রতি দশজনের চারজন। ১৫২০ এর গোটা সেন্ট্রাল আমেরিকা স্মলপক্স একদম ল-ভ- করে ফেলল। কিছু সূত্রানুসারে জানা যায় মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল তখন। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। সংখ্যাটা হচ্ছে ওই সময়ে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের মোট সংখ্যার চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি।

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এইডস এবং ইবোলা ভাইরাস মহামারির চেহারা নিলেও সেই আগের মতো এত পরিমাণে মানুষ মেরে ফেলতে পারেনি। এর কারণ ছিল জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের হাতে যে অস্ত্রটি আছে তা আইসোলেশন নয়Ñ ইনফরমেশন, তথ্য। মানব সভ্যতা তখন মহামারি আটকাতে সক্ষম হল, কারণ, তাদের কাছে জীবাণুর মিউটেশন ও অন্যান্য ইনফরমেশন বা তথ্যের সায়েন্টিফিক অ্যানালাইসিস ছিল বলে। কিন্তু করোনা সম্পর্কে তথ্য থাকলেও তার অনেক বিশ্লেষণ নেই। নেই কেন? কারণ হচ্ছে ভাইরাসরা বদলায়। সেই কারণে বিজ্ঞানীরা সময় চাইছেন। প্রতিষেধক হাতে পেতে সময় লাগবে। মানুষের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হতে সময় লাগবে। কাজেই ফিরে যেতে হচ্ছে পুরনো প্রথায়। আপাতত আইসোলেশন। যাতে আক্রান্তের সংখ্যা অবকাঠামোর সংখ্যার মধ্যে থাকে। যাতে অন্তত আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।

সে কারণেই ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর ক্রিটিকাল কেয়ার আগেই বলেছিল যে, আমাদের দেশে কোভিড-১৯ আটকাতে আরও ১৫-২০ দিন বা তারও বেশি সময় লকডাউন প্রয়োজন ‘হু’-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর ক্রিটিকাল কেয়ার’ (আইএসসিসি) ও ‘আইসিএমআর’ যৌথভাবে আর একটি আরও উন্নতমানের চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করছে। রোগ ছড়ানোর ধরন দেখে ও ঘনজনবসতির কারণে আমাদের দেশে রোগটি দ্রুত স্টেজ থ্রি-তে পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। সে কারণেই শুরু হয়েছে লকডাউন। ১৪৪ ধারা জারি করেছে সরকারও। যার মানে, কোথাও চারজন বা তার বেশি জড়ো হওয়াই এই মুহূর্তে বেআইনি। মানুষ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। এমনকি মন্দির মসজিদগুলোতে জমায়েত নিষিদ্ধ হয়েছে।

অবৈজ্ঞানিক প্রচারকে তীব্র আক্রমণ করে প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে গোমূত্র নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা সরকার সহ্য করবে না। এই তালাবন্দি দশার মানসিক অভিঘাত জনসাধারণের মধ্যে অবশ্যই পড়বে। ল্যানসেট পত্রিকার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে কোয়ারেন্টাইনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অনেক প্রকট। এর প্রভাবে কোয়ারেন্টাইনরত ব্যক্তির দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতা, রাগ, ঘুমের সমস্যা, বিষণœতা দেখা দেয় এমনকি পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) হতে পারে। যাতে মানসিক রোগে মানুষ যেন আক্রান্ত না হন সেজন্যেও বেশ কিছু মনোরঞ্জক প্রকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে। দেশের ব্যাপারে ভারতীয়রা ভীষণ রকমের ঐক্যবদ্ধ। কাজেই কষ্ট বা যন্ত্রণা সহ্য আমাদের করতে হবে এবং অবশ্যই জিততে হবে এই অসম যুদ্ধে। তাই চোয়াল শক্ত করে বলছি, তালাবন্দি দেশে আমরা জেতার প্রতিজ্ঞায় ভাল আছি।

অমিত গোস্বামী : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 

 

 

 
Electronic Paper