ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ক্রান্তিকাল কাটবে কবে

গোলাম মোর্তুজা
🕐 ৮:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৬, ২০২০

গান-কবিতার দেশ- বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িকতার দেশ- বাংলাদেশ। হুজুগের দেশ- বাংলাদেশ। গুজবের দেশ- বাংলাদেশ!

বাংলাদেশকে এতভাবে বিশেষায়িত করার অনেক ব্যাখ্যা আছে। সে সবের দিকে আজ না বলি। আজ আরো একটি বিশেষণ লাগল বাংলাদেশের গায়ে। তা হল, বাংলাদেশ করোনায় আক্রান্ত দেশ। গোটা বিশ্ব যখন আক্রান্ত তখন বাংলাদেশ আক্রান্ত হবে না! এটা বলছি না। বরং বলছি ভাইরাস এল কোথা থেকে? কে এই মরণব্যাধি নিয়ে এল? এটা খুব কষ্টের বিষয়!

গোটা বিশ্ব করোনার ভয়াবহতায় স্তব্ধ। আতঙ্কিত আমরাও। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এল করোনা- আর তো পারি না। চারদিকে সচেতনতার চেয়ে আতঙ্ক ঘটায় বেশি। সচেতনতার ফুল যেন আমাদের মনের জমিনে ফোটেই না।

যে বা যারা দেশের বাইরে ছিলেন- তারা দেশে ফিরছেন করোনাকে দেহে ধারণ করে। কত ভালোবাসা, কত স্নেহ-মায়া-মমতা যে প্রিয়জনকে জড়িয়ে না ধরলে চলবেই না। কোলাকুলি ও সংসারে একই সঙ্গে সময় যাপনে যে পরবর্তীকালে কত ক্ষতির কারণ একবার যদি তারা জানতেন তবে হয়ত মিলনের নেশায় এমন পাগলপারা হতেন না। আহ! বুক চেপে ধরে ব্যথায়। যখন দেখি করোনায় মৃত্যুর পর লাশের পাশে কেউ নেই। কোনো আত্মীয়-স্বজনকে দেখি না আহাজারি করতে। এমনকি লাশ দাফনের পরও সেখানে কাউকে দেখা যায় না। হায়রে! আপনজন। নিজেও মরবে আরেকজনকেও মারবে। এ ভালোবাসার দরকার নেই। মিলনে কেন এত আবেগ। আবেগ যে আপনাকে অন্ধকারের গলি পথে ফেলে দিচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই কেন?

একবার ভাবা দরকার এক মুহূর্তের ভুল যে পরবর্তীকালে সারা জীবনের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াবে । যারা বিদেশে ছিলেন, বিদেশের সবকিছু ভালো লাগছিল। হঠাৎ ভাইরাসের তাড়নে দেশের প্রতি, দেশের প্রিয় মানুষদের প্রতি উথলে উঠল ভালোবাসা। আত্মীয়-স্বজন থেকে কেন তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেন না? বলতে দ্বিধা নেই, তারা না হয় বেবুঝের মতো পরিবারের কাছে ছুটে চলেছেন। কিন্তু আমাদের সুযোগ্য ও দক্ষ প্রশাসকরা কী করলেন? প্রশ্ন এড়ানো যায় না। প্রথম থেকেই যদি প্রবাসীদের কড়া ও কঠোর নজরদারি ও দেখভাল করা হতো তবে বোধ করি আজকের মতো বাজে ভয়ংকর, আতঙ্কগ্রস্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সময় দেখতে হত না। ‘যে যেখানে আছো, সে সেখানে থাকো’- এমন নীতি মানা হলে দেশে আজ ১৭ কোটি মানুষ এত ভয় আর শঙ্কার মধ্যে থাকত না। বিদেশ থেকে অবলীলায় মানুষ এসেছে আবার যে যার মতো প্রাণের উচ্ছ্বাসে গন্তব্যে চলে গেছে।

আর এখন খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছে। এটা যাদের বের করা হচ্ছে তাদের জন্যও লজ্জাকর। গ্রামের মানুষদের কাছে প্রবাসীরা এখন অপরাধী হিসেবে ধরা পড়ছে। গ্রামের সচেতন বা অবচেতনরা সবাই-ই করোনায় আক্রান্তদের তুচ্ছ, হীন ভেবে বসছে। এটা প্রবাসীদের কাছে হেনস্তারই শামিল। গ্রাম থেকে অপরাধীর মতো ধরে নিয়ে যাওয়া বিষয়টি সভ্য না হলেও এখন এ পরিস্থিতিতে সরকারের পারতপক্ষে কিছুই করার নেই। আবার কিছু প্রবাসীর চিত্র দেখে হাসি পায়, ওদের জন্য দুঃখবোধও করি। তাদের চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি না থাকলেও জানালা ভেঙে পালানোর ঘটনা জাতি হিসেবে বেশ লজ্জারই কথা। এটা চোরকে ধরে আবার ছেড়ে দিয়ে পরে প্রয়োজনে হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজার মতো নয় কি? এখন গৃহবন্দি হয়ে থাকার সময়। পরিতাপের বিষয় শুধু বিমানবন্দরে কঠিন ও কঠোর সিদ্ধান্তে থাকলে দেশ আজ এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ত না বলেই বোধ করি।

আমরা গরিব। চিন্তায় দরিদ্র, চেতনাতেও কমপুষ্ট। এটা এ জাতির জন্য কম দুর্নামের বিষয় নয়। এ দেশে দরিদ্রতার হার কত? এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য কোনো তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু দু’পা বাইরে ফেললেই আর দু’চোখ দিয়ে বাইরে তাকালেই বোঝা যায় এদেশের খেটেখাওয়া মানুষদের। এদেশে এমনো পরিবার রয়েছে যে একদিন ঘরের বাইরে বা ইনকামে বাইরে বের না হলে বাড়ির রান্নাঘর অচল হয়ে অলস সময় কাটায়। বাড়ির হাঁড়ি চুলোয় জ্বালাতে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা বাইরে কাজ করতে যেতে পারছে কি? কাজ পাচ্ছে কি? তারা কি করোনা থেকে বাঁচতে পারবে? এ সমস্যার সমাধান কে দেবেন? এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে রাজি হবেন না তা জানি। আবার এ প্রশ্নের জবাব দিতেও কেউ বাধ্য নন তাও জানি। কিন্তু মনে যে প্রশ্ন জাগে। সাধারণ হয়েই তো বাঁচি।

এদেশ বড়ই বিচিত্র। বিপদ একেবারে ঘরের ভেতরে না আসলে আমরা নড়ে-চড়ে উঠি না। আর সচেতনতা জাগাল তো চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই কঠিন ও দুর্লভ। এরপরও বলি কেউ না কেউ তো সচেতন আছেন। ভালো হয়ে বাঁচেন। তবে তা হাতেগোনা। এখন কিছু সংখ্যক মানুষকে মুখে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় দেখছি- এটা মন্দের ভালো। মুখে শুধু মাস্ক পরলেই করোনা থেকে মুক্ত হওয়া গেল না। দরকার সচেতনতার বীজ বোনা।

আমাদের দেশে বহু রোগ আছে, অফুরন্ত শোকও আছে। সেসব রোগ ও শোকে কতজন দিনাতিপাত করছে। তার হিসাব আমাদের কাছে না থাকলেও চোখ খোলা রাখলে দৃশ্যমান হয়। করোনা থেকে বাঁচার জন্য হাজারো প্রচার চারদিকে। বেশ ভালো। তবে তাতে কতটুকু কাজের কাজ হচ্ছে। যদি সে প্রচারণায় আমজনতা নিজেদের একটু পরিবর্তন করতো তবে হয়ত দেশের সকল মানুষ সচেতন হত। মুখে মাস্ক ও নিরাপদ দূরত্বে থাকত। হায় রে দেশ! আমার প্রাণের বাংলাদেশ। রঙ্গে ভরা এ বঙ্গ নিয়ম না মানার যেন সদর দফতর। কিন্তু তাই বলে প্রচার-প্রচারণা থামিয়ে দিলে চলবে না। একসময় হয়ত শুনতে শুনতেই  আমরা সচেতন হব। তখন হয়ত অনেক কিছুই হারাতে হবে।

এদেশে দুর্যোগ মানেই কিছু ব্যবসায়ীর পোয়াবারোর সময় চলে আসে। করোনার ক’দিন হতে না হতে চাল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেল। আর করোনার ভয়ে মাস্ক কিনতে যাওয়া যে কোনো মানুষের জন্যই একটা যন্ত্রণার কারণ ছিল। এখন অবশ্য এটা অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে। তবে এ রকম অভাবিত পরিস্থিতি সৃষ্টি কেন হবে এ বাংলাদেশে? খুচরা কিংবা পাইকারি কোথাও কোনো পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে না! নজরদারিত্ব কম থাকে। আর হলেও অপ্রতুল। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ান। বলেন ঘাটতি, তাই দাম বাড়তি। অথচ তারাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে করে টালমাটাল।

আহ! যেখানে করোনা মোকাবেলায় আমাদের দেশসহ গোটা বিশ্ব আতঙ্কিত, থতমত। সেখানে কিছু নির্লজ্জ, বেহায়া, ইতর শ্রেণির ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লোভের আশায় ফন্দি আঁটেন। সাধারণ গরিব-দুঃখী, মেহনতি মানুষদের জন্য তাদের কোনো দায় নেই!

তারা লাগামহীন ঘোড়া হয়ে ঘুরবেন- নিরন্ন খেটে খাওয়া মানুষদের বেঁচে থাকা নাভিশ্বাসের চড়ক গাছে তুলবেন। এই কাজ করেন যারা তারা মনুষ্যজাতির কলঙ্ক। এরা সমাজের কীট। মানবতা বিরোধী। দেশের চলমান সংকটে সবাই যখন জীবন বাঁচাতে দোয়া ও দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সে সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ানো কাপুরুষতা ও বিবেকহীনতারই নামান্তর। এদের চিহ্নিত করে চলমান আদর্শ আইনের আওতায় এনে বিচার করা ঈমানি দায়িত্ব।

একদিকে করোনা আরেকদিকে পণ্যের মূল্য বাড়ানো- দুটোই যেন আমাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। সরকারের পক্ষে এগুলো একা সমাধান করা মুশকিল। দেশ আমার, আপনার, সবার। তাই সবাই মিলে দুর্যোগ মোকাবেলায় এগিয়ে আসাই মানুষের কাজ। দেশ ও দেশের মানুষদের ভালো রাখার জন্য প্রয়োজনে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। অপরাধী বা কুচক্রী যদি নিজের দলের হয় তবুও ছাড় দেওয়া যাবে না। দলান্ধ বা স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে কাজ করা যাবে না। মোটকথা ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ নীতিতে অবিচল থাকতে হবে।

গোলাম মোর্তুজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 

 

 
Electronic Paper