ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মার্চ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু

সাধন সরকার
🕐 ৯:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২১, ২০২০

স্বাধীনতার মাস মার্চ। বাঙালির জাতীয় জীবনে অগ্নিঝরা মার্চের প্রতিটি দিনের গুরুত্ব বিভিন্ন দিক দিয়ে অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতি নিজেদের অধিকার আদায়ের পথে ঐক্যবদ্ধ হয়। মূলত ১ মার্চ থেকেই সমগ্র বাংলা জুড়ে বঙ্গবন্ধুর অলিখিত নির্দেশনা মোতাবেক সবকিছু চলতে থাকে।

জাতির পিতা হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা। জাতির পিতার নেতৃত্বে মার্চ মাসেই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালিরা মার্চের শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল লড়াই করেই অধিকার আদায় করে নিতে হবে। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়লাভের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জাতির পিতার হাতে ক্ষমতা দিতে তালবাহানা করতে থাকে। ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। ইয়াহিয়ার এ হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সবুজ জমিনে তোলা হয় লাল সবুজের বাংলাদেশের পতাকা। একে একে সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, শিক্ষক, সাধারণ জনতা সবাই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

অবশেষে জাতির পিতা ৭ মার্চ বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। জাতির পিতাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মহান আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এ ভাষণ। জাতির পিতা এ ভাষণে স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহবানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। মুক্তিকামী মানুষের জন্য এ ভাষণের আবেদন চিরস্থায়ী। বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিকামী, অধিকার ও বঞ্চনার শিকার মানুষের জন্য এ ভাষণ হতে পারে অনন্ত প্রেরণার উৎস। এ ভাষণকে সর্বকালের সেরা ভাষণ বললেও অত্যুক্তি হবে না, কেননা বিশ্বের আর কোনো দেশের নেতার ভাষণ ৭ মার্চের ভাষণের মতো মানুষের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এ বজ্রকন্ঠের বাণী ছিল অলিখিত এবং উপস্থিত একমাত্র বক্তার ভাষণ। মূলত এ ভাষণই ছিল বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত্তি। এককথায়, ৭ মার্চের ভাষণের পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় এবং অতঃপর চূড়ান্ত বিজয় আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের স্বজনদের হত্যার ঘটনায় ঘটেনি, পুরো বাঙালি জাতির আত্মা ও স্বপ্নকে হত্যা করা হয়। মুক্তির এ মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তখনই ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা ঘটানো হয়। জাতির পিতা পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বাংলা, বাঙালি, বঙ্গীয় ব-দ্বীপ আর বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা। তার জীবনের প্রথম লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করা।

তিনি সবসময় দেশ নিয়ে ভেবেছেন, দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। চলতি বছরের ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কাল ‘মুজিববর্ষ’। আর ২০২১ সালে বাংলাদেশ উদ্যাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। জাতির পিতা দেখিয়ে গেছেন কীভাবে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়, কীভাবে নিজের জীবনবাজি রেখে দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে লড়ে যেতে হয়।

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা তারই দেখানো পথে এগিয়ে চলেছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ অনেক ক্ষেত্রে বিশে^ রোল মডেল। যে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এখন সামগ্রিক বিবেচনায় সেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। বিশে^র উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। এখন শুধু দরকার সবক্ষেত্রে সুশাসনকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়ের শাসনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যার যার জায়গা থেকে কাজ করে যাওয়া। জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণ প্রজন্মের দায় সবচেয়ে বেশি। জাতির পিতার আদর্শ টিকিয়ে রেখে তারই দেখানো পথে কাজ করে যাওয়ার জন্য তরুণ-যুবাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যেতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-রাজনীতির মধ্যে শৃঙ্খলা ও মানবিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। দুর্নীতি বন্ধে সর্ব্বোচ গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বারোপসহ তাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি জোর দিতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিহিংসার বদলে সহনশীলতার চর্চা বাড়াতে হবে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শিশু ও নারীদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে আইনের প্রয়োগ দ্রুত ও কার্যকরভাবে করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ দূষণকারী ও নদী দখল-দূষণকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতসহ পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। জাতির পিতা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীনে নেতৃত্ব না দিলে আমরা আমাদের প্রিয় সোনার বাংলা পেতাম না। জাতির পিতা কোনো দলের নন, তিনি সমগ্র বাংলার, বাঙালির, বাংলাদেশের, বিশ্বের জাতির পিতার চিন্তা ও আদর্শ আজ তারুণদের প্রেরণা ও সম্পদ। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যহীন ও শোষণহীন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। তার স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

সাধন সরকার : কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী
[email protected]

 
Electronic Paper